নাগরিক আন্দোলনে সরকারের বিরোধিতা হলেও, তার ছাপ পড়ল না উপনির্বাচনে। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে নাগরিক আন্দোলনে ধারাবাহিকতা দেখেছিল বাংলা। যে আন্দোলনে মূলত উদ্বেল হয়েছিল শহর এবং জেলার মফস্সল বা ছোট শহর। যে আন্দোলন থেকে শাসকদলের বিরুদ্ধে স্বর উঠেছিল। কিন্তু আরজি কর আবহে রাজ্যের ছ’টি বিধানসভার উপনির্বাচনে সেই নাগরিক আন্দোলনের কোনও প্রভাবই পড়ল না! ছ’টি আসনের মধ্যে নৈহাটি এবং মেদিনীপুর— এই দু’টিই ‘শহরের আসন’ ছিল। নৈহাটি কলকাতা লাগোয়া। শুধু তা-ই নয়, আরজি করের নির্যাতিতার বাড়ির ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে নৈহাটি। সেখানে দাঁড়াতেই পারেনি বিরোধীরা। দাপট দেখিয়ে জিতেছে তৃণমূল। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট এবং গত লোকসভায় বিধানসভাওয়াড়ি যে ব্যবধান ছিল নৈহাটিতে, তা-ও ছাপিয়ে গিয়েছে জোড়াফুল শিবির।
নাগরিক আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে। যদিও উপনির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের কেউ প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অন্যতম এক নেতা দুপুরে বলেন, ‘‘ভোটের ফল নিয়ে আমরা আদৌ কোনও কথা বলব কি না, তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি।’’
নৈহাটিতে ২০২১ সালে তৃণমূল জিতেছিল প্রায় ১৯ হাজার ভোটে। ২০২৪ সালের ব্যারাকপুর লোকসভার অন্তর্গত এই বিধানসভায় তৃণমূলের ‘লিড’ কমে হয়েছিল ১৫ হাজার। উপনির্বাচনে সেই ব্যবধান প্রায় ৫০ হাজারে পৌঁছেছে। অন্য দিকে, মেদিনীপুর আসনে ২০২১ সালে তৃণমূলের জুন মালিয়া জিতেছিলেন ২৪ হাজারের বেশি ভোটে। কিন্তু সেখানেই লোকসভা ভোটে জুনের ‘লিড’ কমে হয়েছিল দু’হাজারের কিছু বেশি। উপনির্বাচনে সেই ব্যবধান বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৩ হাজার।
আরজি কর নিয়ে নাগরিক আন্দোলনে ঝান্ডাহীন হয়ে সব থেকে বেশি সম্পৃক্ত ছিল বামেরা। কিন্তু দেখা গেল, এই দুই আসনেই বামেরা জামানত খুইয়েছে। অর্থাৎ, আন্দোলনের কোনও সুফল তারা ইভিএমে তুলতে পারেনি। বিজেপিও আরজি কর নিয়ে তৃণমূলকে আক্রমণ করে গিয়েছে। নাগরিক আন্দোলনে সে ভাবে ভিড়তে না পারলেও পৃথক ভাবে আন্দোলন জারি রেখেছিল পদ্মশিবির। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘দফা এক দাবি এক, মমতার পদত্যাগ’। কিন্তু কোনও কিছুতেই কিছু হল না।
কেন হল না, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে বাম শিবিরের নেতারা একান্ত আলোচনায় মানছেন, নাগরিক আন্দোলন হলেও সমান্তরাল কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। প্রক্রিয়াও ছিল না। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। সিপিএমের তরুণ নেতা সৃজন ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘উপনির্বাচনে নানা সমীকরণ মাথায় রেখে মানুষ ভোট দেন। এই ভোটে সরকার বদলের বিষয় থাকে না। ফলে এ দিয়ে নাগরিক আন্দোলনকে মাপা ঠিক হবে না।’’ তাঁর দাবি, ‘‘পরবর্তী কালে যখন তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষ সার্বিক ভাবে মতদানের সুযোগ পাবেন, যখন বদলের প্রেক্ষাপট থাকবে, তখন এর প্রতিফলন দেখা যাবে।’’ বিজেপি নেতা তরুণজ্যোতি তিওয়ারিরও বক্তব্য, ‘‘ভোটে প্রতিফলন হল না মানে নাগরিক আন্দোলন বা তার স্বতঃস্ফূর্ততা নস্যাৎ হয়ে যায় না। আর উপনির্বাচনে কী হয়, সবাই জানে।’’ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর দাবি, ‘‘২০২৬ সালের ভোটে নৈহাটি, মেদিনীপুর তো বটেই, তালড্যাংরা আর মাদারিহাটও আমরা জিতব।’’
এ কথা ঠিক যে, সাধারণত উপনির্বাচনে শাসকদলই জেতে। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। বামজমানার শেষ পাঁচ বছরে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনা কেন্দ্র করে নাগরিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এ-ও বাস্তব যে, সেই সময়ে সমান্তরাল ভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনও ছিল। এবং সেই আন্দোলনের ‘মুখ’ ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখা গিয়েছিল ২০০৯ এবং ২০১০ সালে বাংলার তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনে সিপিএমকে হারিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। সেই তালিকায় ছিল কলকাতার পূর্ব বেলগাছিয়াও। প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর আসনে পরাস্ত হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী রমলা চক্রবর্তী। আরজি কর পর্বে নাগরিক আন্দোলন পুরোপুরি ‘অরাজনৈতিক’ ছিল না। তবে সেই আন্দোলন ছিল দলহীন, পতাকাহীন। রাজনৈতিক মহলের অনেকের বক্তব্য, বিরোধী পরিসরে বাম এবং বিজেপির ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ পতাকাহীন আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখিয়েছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেই আন্দোলনের ‘লেজুড়’ হয়েছিল।
বাম এবং বিজেপির প্রথম সারির নেতারা একান্ত আলোচনায় মানছেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে তৃণমূলের গণভিত্তি অনেক গভীরে প্রোথিত। সংগঠনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বাস্তুতন্ত্র (ইকনমিক ইকোসিস্টেম) তৈরি করে ফেলেছে তৃণমূল। এক প্রবীণ সিপিএম নেতার বক্তব্য, ‘‘সরকারি বিভিন্ন ভাতা ছাড়াও তৃণমূলের সঙ্গে থাকার সুবাদে প্রতিটি এলাকার বহু মানুষ পেট চালাচ্ছেন। তাঁরা যে সবাই দুর্নীতিতে রয়েছেন তা নয়। কিন্তু তাঁদের কাছে তৃণমূল রুটিরুজি। এই অংশই তৃণমূলকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে।’’ সামাজিক ভাতার যে প্রভাব প্রতিটি ভোটে পড়ছে, তা মানছেন বিজেপি নেতারাও। হয়তো সে কারণেই তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলছেন, ‘‘লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়ে যাঁরা কুৎসা করেন, তাঁদের উচিত লক্ষ্মীর ভান্ডারকে প্রণাম করা। শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নকল করলে হবে না। মা লক্ষ্মীদের প্রতি আরও যত্নশীল হতে হবে। এঁরাই বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’’
গত লোকসভা ভোটে শহরাঞ্চলে খারাপ ফল করেছিল তৃণমূল। যার ভিত্তিতে দলে রদবদলও করতে চলেছে তারা। আরজি কর-কাণ্ড নিয়ে নাগরিক আন্দোলন দেখে অনেকেরই বক্তব্য ছিল, লোকসভা ভোটের ‘মনোভাব’ই প্রতিফলিত হচ্ছে রাস্তায়। কিন্তু উপনির্বাচন তেমন কথা বলেনি। যা তৃণমূলের জন্য ‘স্বস্তিদায়ক’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy