গ্রাম থেকে শহর, উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে সর্বত্রই তৃণমূলের দাপট। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
তৃণমূল কি ছয়ে-ছয় হবে? এই ছিল প্রশ্ন। উত্তর পাওয়া গেল শনিবার— তৃণমূলই ছয়ে-ছয়।
বাংলার ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে শাসকদল তৃণমূল যে ‘একাধিপত্য’ দেখাতে চলেছে, সেই ইঙ্গিত ছিলই। তবে কৌতূহল ছিল, বিজেপির হাতে থাকা মাদারিহাট পদ্মশিবির ধরে রাখতে পারবে কি না। ফল ঘোষণার পরে দেখা গেল, তৃণমূল শুধু ছক্কাই হাঁকাল না, ইতিহাস গড়ে প্রথম বারের জন্য আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট বিধানসভা আসনে জোড়াফুল ফুটল। ভোটের ফলাফলে বাকি পাঁচ আসনের মতো মাদারিহাটও বিজেপির ছন্নছাড়া অবস্থা বেআব্রু করে দিল। পাশাপাশিই আরও এক বার ভোটের ফল প্রমাণ করে দিল, বাংলায় বাম-কংগ্রেস এখন প্রান্তিক শক্তি। গ্রাম, শহর— কোনও আসনেই তাদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। একমাত্র হাড়োয়া আসনে বাম সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থী পিয়ারুল ইসলাম দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন। তবে ছ’টি আসনেই জামানত খুইয়েছেন বাম এবং বাম সমর্থিত প্রার্থীরা। পৃথক ভাবে লড়ে ছ’টি আসনেই জামানত খুইয়েছে কংগ্রেসও।
মাদারি-কা খেল্
রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ভোটের ফলাফল ‘প্রত্যাশিত’ই হয়েছে। তবে মাদারিহাটে ‘লড়াই’ হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন। লড়াই হয়নি। বিজেপি কার্যত ‘আত্মসমর্পণ’ই করেছে শাসক শিবিরের কাছে। প্রসঙ্গত, এ যাবৎ কোনও ভোটেই মাদারিহাটে জিততে পারেনি তৃণমূল। চা-বাগান ঘেঁষা এই আসনটি ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ছিল বামশরিক আরএসপি-র দখলে। ২০১৬ এবং ২০২১ সালের ভোটে এই আসনে জিতেছিলেন বিজেপির মনোজ টিগ্গা। সেই মনোজকে এ বার লোকসভায় দাঁড় করিয়েছিল বিজেপি। আলিপুরদুয়ার আসন থেকে তিনি জিতে সাংসদ হয়েছেন। সে কারণেই মাদারিহাটে উপনির্বাচন হয়েছে। যে ভোটে জিতে বিধায়ক হতে চলেছেন তৃণমূলের জয়প্রকাশ টোপ্পো।
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে মাদারিহাটে ২৯ হাজার ভোটে হেরেছিল তৃণমূল। তবে গত লোকসভায় সেই ব্যবধান অনেকটা কমে যায়। বিজেপি মাদারিহাট থেকে ১১ হাজার ভোটে ‘লিড’ পায়। অর্থাৎ, তিন বছরের মধ্যে ব্যবধান কমে যায় প্রায় ১৮ হাজার ভোটের। যাকে ‘ইতিবাচক’ বলেই মনে করেছিল তৃণমূল। মাদারিহাটের আদিবাসী মহল্লায় খ্রিস্টান ভোটে বিজেপির যে ‘আধিপত্য’ তৈরি হয়েছিল, তা-ও এ বার ভাঙা যাবে বলে ভোটের আগে থেকেই একান্ত আলোচনায় জানাচ্ছিলেন শাসকদলের নেতারা। উপনির্বাচনে খ্রিস্টান ভোটের ক্ষেত্রে বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ জন বার্লা কী ভূমিকা নিচ্ছেন, বিজেপির প্রথম সারির নেতারা একান্ত আলোচনায় সে বিষয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন। বার্লার ভূমিকা নিয়ে নানাবিধ জল্পনা ছিল। উপনির্বাচন পর্বেই তৃণমূল নেতাদের নিজের বাড়িতে ডেকে বৈঠক করেছিলেন বার্লা। যে ঘটনা বিজেপির ‘সন্দেহ’ কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, পদ্মশিবিরের পোক্ত মাটিতে আঘাত হেনেছে তৃণমূল। এমনিতেই দলবদল করে বিজেপির নয়-নয় করে ১০ জন বিধায়ক তৃণমূলে চলে গিয়েছেন। এ বার জেতা মাদারিহাটও হারাল পদ্মশিবির। মাদারিহাটের তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যসভার তৃণমূল সাংসদ প্রকাশ চিক বরাইক বলেছেন, ‘‘মানুষ বিজেপির বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের পক্ষে রায় দিয়েছে।’’ উল্লেখ্য, ভোটের আগেই প্রকাশ বলেছিলেন, ‘‘মাদারিহাটেও খেলা হবে।’’ হয়েছেও তাই।
বঙ্গে বিপর্যস্ত বিজেপি
উপনির্বাচন ঘোষণা হওয়ার পরে প্রচার পর্ব থেকেই বিজেপিকে খুব একটা ‘সক্রিয়’ দেখায়নি। পদ্মশিবিরের নেতাদের এমন ভাবে ঝাঁপাতে দেখা যায়নি, যাতে মনে হয় বিজেপি জেতার জন্য নেমেছে। ফলে তৃণমূল খানিকটা ফাঁকা মাঠই পেয়েছিল। কারণ, শাসকদলকে কার্যত কোনও বিরোধিতার মুখেই পড়তে হয়নি। ভোটের ফলেও সেটাই প্রতিফলিত। ছ’মাস আগে লোকসভা ভোটে বাংলায় ধাক্কা খেয়েছিল বিজেপি। উপনির্বাচনে তার থেকেও শোচনীয় পরিস্থিতি তৈরি হল প্রধান বিরোধী দলের। যদিও রাজ্য বিজেপি এই হারকে ‘বিপর্যয়’ মানতে চায়নি। রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘প্রত্যেক নির্বাচনী জয়-পরাজয় থেকেই রাজনৈতিক শিক্ষা নিতে হয়। তবে আমরা এটাকে বিপর্যয় বলে মনে করি না।’’ সেই সঙ্গে শমীকের সংযোজন, ‘‘ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে বিজেপি সারা দেশে মাত্র দু’টি আসন পেয়েছিল। সেই সময়ে অনেকে বলেছিলেন, পার্টি উঠে যাবে। সেই জায়গা থেকে আমরা সারা দেশে এই জায়গায় এসেছি।’’
গ্রাম-শহর
যে ছ’টি আসনে উপনির্বাচন ছিল, তার মধ্যে নৈহাটি এবং মেদিনীপুর শহরাঞ্চল। বিধানসভার মধ্যে কিছু পঞ্চায়েত এলাকা থাকলেও সেগুলি শহরঘেঁষা এলাকা। বাকি চার কেন্দ্র সিতাই, মাদারিহাট, তালড্যাংরা এবং হাড়োয়া পুরোটাই গ্রাম। সে দিক থেকে তৃণমূলের এই জয় গ্রাম-শহর দুই অংশের মানুষেরই জনমতকে প্রতিফলিত করল বলে দাবি শাসক শিবিরের। উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ এবং রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে বিস্তৃত ছ’টি আসনের ফল সার্বিক ভাবে রাজ্যের প্রেক্ষিতেও ‘ইঙ্গিতপূর্ণ’ বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
অঙ্ক কী সোজা
২০১৯ সালের লোকসভা ভোট থেকেই বঙ্গ রাজনীতির সমীকরণ বদলে গিয়েছিল। তৃণমূলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল বিজেপি। রাজনীতির ময়দানের পার্শ্বরেখায় সরে গিয়েছিল বাম-কংগ্রেস। সেই ধারা অব্যাহত ছিল ২০২১ সালের বিধানসভা এবং গত লোকসভা ভোটেও। উপনির্বাচনেও সেই অঙ্কের কোনও বদল হল না। যদিও সিপিএম রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘আদিবাসীর মধ্যে বিজেপির আধিপত্য যে কমছে, তার প্রমাণ যেমন ঝাড়খণ্ডের ফলাফলে প্রতিফলিত, তেমনই মাদারিহাটেও সত্য। বাংলায় দ্বিমেরু রাজনীতি তখনই ভাঙবে, যখন বিজেপি দুর্বল হবে। সেটা হয়েছে। এটা জারি রাখতে এবং আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে প্রয়াস চালিয়ে যাব।’’
সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে উপনির্বাচনে সাধারণত জেতে শাসকদল। কারণ, এই নির্বাচনে সরকার বদলের কোনও সুযোগ থাকে না। বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের মতো উত্তেজনাও থাকে না। ফলে বিরোধী শিবিরের ভোটারের তুলনায় কম বুথমুখী হন। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। বাম জমানার শেষ দিকে তিনটি বিধানসভার উপনির্বাচনে সিপিএমকে হারিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল। আবার তৃণমূল জমানায় সাগরদিঘি উপনির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের জোটপ্রার্থীর কাছে তৃণমূলের হার রাজ্য রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। তবে এই ব্যতিক্রম ছাড়া রাজ্যে উপনির্বাচনে সাধারণত শাসকেরই জয়জয়কার হয়েছে। অনেকের মতে, উপনির্বাচনে তাঁরা জিতবেন ধরে শাসক শিবিরের কর্মী-সমর্থকেরাও একটু ঢিলে দিয়ে থাকেন। তাঁদের সেই ‘আত্মতুষ্টি’ থেকে বার করে ভোটের কাজে নামানোতেও শাসক শিবিরের সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় থাকে। তৃণমূল ছ’টি আসনের উপনির্বাচনে সেটা করতে পেরেছে বলেই শাসক শিবিরের দাবি।
আরজি কর পর্বের পরে শাসকের বিরুদ্ধে ‘নাগরিক স্বর’ গর্জে ওঠার প্রেক্ষিতে অনেকেরই কৌতূহল ছিল উপনির্বাচনের ফলাফল নিয়ে। ফলিত স্তরে দেখা গেল, তৃণমূল শুধু ভোটে জিতল তা-ই নয়, জিতল বিরোধীদের ‘দুরমুশ’ করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy