সংবাদমাধ্যমের লাগাতার চাপে শেষ পর্যন্ত চকোলেট বোমা এবং দোদমার উৎপাদন এবং বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞাই বহাল রাখল রাজ্য পরিবেশ দফতর। কিন্তু কালীপুজোর ন’দিন মাত্র আগে যখন এই নিষেধাজ্ঞা জারি হল, তত ক্ষণে ওই বাজির উৎপাদন মোটামুটি শেষ। এমনকী নিষিদ্ধ বাজির ৭০ শতাংশ পৌঁছেও গিয়েছে খুচরো বিক্রেতাদের দোকানে।
কোনও বাজিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলে তা খোলাখুলি বিক্রি করা যায় না। কিন্তু এ বার যাতে চকোলেট বোমা এবং দোদমা প্রকাশ্যে বিক্রি করা যায়, তার জন্য শব্দের পরীক্ষায় মঙ্গলবারই চকোলেট বোমা ও দোদমাকে পাশ করিয়েছিল রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। কালীপুজোয় শব্দের তাণ্ডবের আতঙ্কে কাঁটা হয়েছিলেন মানুষ। আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, বৈধ লাইসেন্সবিহীন কারখানায় তৈরি বাজি নিয়েই পরীক্ষা চালিয়েছে পর্ষদ।
তার পরেই বৃহস্পতিবার চকোলেট বোমা ও দোদমা নিয়ে নিজেদের অবস্থান বদলে ফেলল রাজ্য সরকার। যদিও পরিবেশ ভবনে রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন, ‘‘শব্দবাজি নিয়ে অবস্থান বদলের কিছু নেই। চকোলেট বোমা ও দোদমা বরাবরই নিষিদ্ধ ছিল। এ বারও নিষিদ্ধ-তালিকাতেই থাকছে।’’
তার মানে, মঙ্গলবারের শব্দ-পরীক্ষাটি যে গলদপূর্ণ ছিল, সে কথা প্রকারান্তরে এ দিন মেনে নিল রাজ্য সরকার। মঙ্গলবারের পরীক্ষায় চকোলেট বোমা এবং দোদমা, দু’টোই ৯০ ডেসিবেলের কম শব্দমাত্রা দেখিয়েছিল। অথচ খেলনা পিস্তলে ব্যবহার করা ক্যাপ, কালীপটকা কিংবা নিরীহ আলুবোমার মতো
বাজি ছাড়া তো ৯০ ডেসিবেলের নীচে শব্দবাজি হয়ই না।
কী উপায়ে তা হলে চকোলেট বোমা এবং দোদমা পরীক্ষায় পাশ করেছিল? সারা বাংলা আতসবাজি উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান বাবলা রায়ের ব্যাখ্যা, চকোলেট বোমার ভিতরে একটি কাগজের বাক্সের ভিতরে মশলা ঠাসা হয়। ওই কাগজ কতটা পুরু হবে, তার উপরেই শব্দমাত্রা নির্ভর করে। অতীতে সেই কাগজ পাঁচ বা ছয় মিলিমিটার পুরু করা হতো। কিন্তু বহু ভাবনাচিন্তা পরীক্ষানিরীক্ষার পর এ বার তা তিন বা চার মিলিমিটার পুরু করা হয়েছিল। তার ফলেই চকোলেট বোমার আওয়াজ ৯০ ডেসিবেলের নীচে থেমে গিয়েছিল। একই উপায়ে পাশ করেছিল দোদমাও। বাজি উৎপাদকদের একাংশই জানাচ্ছেন, পরিকল্পনা ছিল, অল্প কিছু নমুনা শব্দমাত্রায় পাশ করিয়ে নিয়ে বাজারে বেশি শব্দমাত্রার বাজি ছেড়ে দেওয়া। সংবাদমাধ্যমের চাপে সেই পরিকল্পনা সফল হল না।
লালবাজারের খবর, রাজ্য সরকারের ঘোষণা মেনে আজ, শুক্রবারই নিষিদ্ধ বাজির তালিকা-সহ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। শোভনবাবুর মন্তব্য, ‘‘শব্দবাজি তৈরি করে, বিক্রি করে বা কিনে অযথা নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না।’’ এ বার শুধু বাজি বাজেয়াপ্ত করাই হবে না, শব্দবাজির ক্রেতা-বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
কিন্তু এর পরেও কালীপুজোয় শব্দবাজির তাণ্ডবে মানুষের হয়রানি কমবে কি? ফি বছরই শব্দবাজি নিষিদ্ধ হয়। প্রতিবারই নিয়ম করে পরিবেশ মন্ত্রীরা কালী পুজোর আগে নিষিদ্ধ বাজি ব্যবহার নিয়ে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কেই সতর্ক করেন। কিন্তু শব্দবাজির কেনা-বেচা চলেই। পুলিশ দেখেও দেখে না। হাইকোর্টের রোষে যাতে পড়তে না হয়, তার জন্য মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে শব্দবাজি বাজেয়াপ্ত করে পুলিশ। পুলিশের মালখানা থেকে সেই আটক বাজি কোথায় যায়, তা নিয়ে পরিবেশ কর্মীদের প্রশ্ন অনেক দিনের।
তা ছাড়া বাজি উৎপাদকরা জানাচ্ছেন, বাজি তৈরি এবং বিক্রিবাটা ইতিমধ্যেই অনেকটা হয়ে গিয়েছে। ফলে আদৌ শব্দদৈত্যকে বোতলবন্দি করা যাবে কি না, সে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার এক বাজি উৎপাদক কবুল করলেন,
প্রতি বছর কালীপুজো এবং অন্য পুজোর জন্য যে পরিমাণ বাজি তৈরির বরাত তাঁরা পান, এ বারেও তা-ই পেয়েছেন। সেই পরিমাণ বাজি তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেই বাজির ৭০ শতাংশ পুজোর আগেই বিক্রিও হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপুজোর ভাসানে, লক্ষীপুজোয় সেই বাজিই দেদার ফেটেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বাজি উৎপাদকের দাবি, ছোট চকোলেট বোমা ১০০টি-র প্যাকেট বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়। বড়গুলি বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকায়। অর্থাৎ শব্দ-পরীক্ষার ‘নাটক’-এর আগেই নিষিদ্ধ বাজি উৎপাদন করে উৎপাদকেরা নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিয়েছেন।
শব্দবাজি নিষিদ্ধ করার সদিচ্ছা যদি রাজ্য সরকারের থাকত তবে মার্চ-এপ্রিল মাস থেকেই বাজি কারখানায় তল্লাশি চালানোর প্রয়োজন ছিল। সেটা করা হয়নি। এর পিছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করছেন পরিবেশকর্মীরা। যেখানে বাজি তৈরি হয় সেখানকার পঞ্চায়েত, পুরসভা, পুলিশ এবং বাজি উৎপাদকদের যোগসাজসের ফলেই শব্দবাজি উৎপাদন ঠেকানো যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy