আয়কর দফতর এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে তৃণমূল তাদের আয়-ব্যয়ের যে অডিট রিপোর্ট পেশ করে চলেছে, তাতে অডিটরের সদস্য নম্বরই দেওয়া নেই! নেই সইয়ের নীচে স্পষ্ট করে লেখা অডিটরের নামও! পাশাপাশি আয়কর দফতরে অডিটরের পেশ করা রিপোর্টের মুখবন্ধের বয়ানও বিধিসম্মত নয়। তাই এই রিপোর্ট বৈধ নয় বলেই মত দিলেন ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইন্ডিয়ার (ইস্টার্ন ইন্ডিয়া রিজিওনাল কাউন্সিল) চেয়ারম্যান প্রমোদদয়াল রুংতা।
আয়কর দফতর ও নির্বাচন কমিশনে পেশ করা তৃণমূলের অডিট রিপোর্টে পি কে চক্রবর্তী নামের যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টের নাম রয়েছে, তিনি যে গত চার বছর ধরে অ্যালঝাইমার্স রোগে ভুগছেন, তা সোমবারই আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর অফিসও বন্ধ। এর পরেই মঙ্গলবার তৃণমূলকে তীব্র আক্রমণ করেছে বিরোধীরা। কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা আব্দুল মান্নান শাসক দলকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘তৃণমূল একটা অন্যায় আড়াল করতে গিয়ে আর একটা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে! তারা হিসেবে একটা জালিয়াতি করেছে। তার অডিটে আবার জালিয়াতি হয়েছে!’’ বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য জানান, তৃণমূলের এই জালিয়াতি নিয়ে তাঁরা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে ইতিমধ্যেই ওই দলের বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, ‘‘ওরা নির্বাচন কমিশনের কাছে জালি কাগজ পেশ করছে। নির্বাচন কমিশনকে যারা জালি হিসাব দেয়, তারাই আবার মুখে সততার কথা বলে!’’
তৃণমূল অবশ্য এ প্রসঙ্গে এখনও বিশদে কোনও ব্যাখ্যায় যেতে নারাজ। এ দিনও তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর জবাব, ‘‘এটা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই! কে অডিটর, সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আগে জানি।’’ দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সী এ বিষয়ে যাবতীয় প্রশ্ন এড়িয়ে চলছেন।
তৃণমূলের সংবিধানের ১১(সি) ধারা অনুযায়ী, দলীয় তহবিল এবং যাবতীয় লেনদেনের দায়িত্ব কোষাধ্যক্ষের। এই মুহূর্তে তৃণমূলের কোষাধ্যক্ষ বিধায়ক তমোনাশ ঘোষ। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমি মাত্র দিন দশেক হল এই দায়িত্ব নিয়েছি। ফলে এ বিষয়ে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’’ যদিও দলের একটি সূত্রের দাবি, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই তমোনাশবাবু সর্বভারতীয় স্তরে তৃণমূলের কোষাধ্যক্ষ। তৃণমূলের একটা বড় অংশের অবশ্য বক্তব্য, কাগজে-কলমে দায়িত্ব যার উপরেই থাক, দীর্ঘদিন ধরেই দলের আয়ব্যয়-সহ যাবতীয় কাজকর্ম দেখতেন প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। ফলে অডিট রিপোর্টের দায়ও তাঁরই। মুকুলবাবু ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, অডিট রিপোর্টে কোনও গোলমাল নেই। সব ঠিকঠাকই আছে।
তা হলে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইন্ডিয়ার কর্তা কোন যুক্তিতে ওই অডিট রিপোর্টকে বৈধ নয় বলে মত দিলেন?
তৃণমূলের পেশ করা অডিট রিপোর্টের প্রতিলিপি মঙ্গলবার আনন্দবাজারের পক্ষ থেকে দেখানো হয়েছিল প্রমোদদয়াল রুংতাকে। এই প্রতিলিপি দেখে প্রমোদদয়ালবাবু বলেন, ‘‘আয়কর দফতরে অডিটরের পেশ করা রিপোর্টের মুখবন্ধে বাঁধাধরা বয়ান থাকবে। এই রিপোর্টের মুখবন্ধে যে বয়ান রয়েছে, তা আয়কর দফতরের গ্রহণ করার কথা নয়। এ ছাড়া অডিট রিপোর্টে যিনি সই করবেন, তাঁকে আমাদের ইনস্টিটিউটের সদস্য হতে হবে। সদস্যপদ না থাকলে সেই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কোনও ভাবেই কোনও অডিট রিপোর্টে সই করতে পারেন না।’’ বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন-এ যেমন তাঁদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর বাধ্যতামূলক ভাবে দিতে হয়, তেমনই অডিট রিপোর্টেও চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট-কে তাঁর সদস্য নম্বর বাধ্যতামূলক ভাবে দিতে হয়।
তৃণমূলের অডিট রিপোর্টের যে প্রতিলিপি আনন্দবাজারের হাতে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, এই রিপোর্টের নীচে একটি দুর্বোধ্য সই রয়েছে। অডিট রিপোর্টের সেই প্রতিলিপি দেখে প্রমোদদয়ালবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘কার সই এটা? সইয়ের নীচে তো একটা নাম থাকা । সদস্য নম্বর বা নাম কোনওটাই নেই! এই অডিট রিপোর্ট কখনও বৈধ হতে পারে না।’’
ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যাঁরা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফার্ম চালান, নিয়ম মতো তাঁদের প্রতি বছর সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ করাতে হয়। প্রমোদদয়ালবাবু জানিয়েছেন, ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, পি কে (প্রাণকুমার) চক্রবর্তীও প্রতি বছর ৪ হাজার টাকা দিয়ে সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ করিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সোমবারেই তাঁর স্ত্রী ও ছেলে জানিয়েছেন, প্রাণকুমারবাবু এতটাই অসুস্থ যে সাধারণ প্রশ্ন করলেও ভুল উত্তর দিচ্ছেন। তিনি এখন কোনও কাজ করার অবস্থায় নেই। তাঁর ফার্মও বন্ধ। প্রাণকুমারবাবুর চিকিৎসক কৃষ্ণাঞ্জন চক্রবর্তীও মঙ্গলবার জানান, যে ধরনের শারীরিক সমস্যায় প্রাণকুমারবাবু আক্রান্ত, তাতে এই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব।
প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কে প্রাণকুমারবাবুর সদস্যপদ নিয়মিত পুনর্নবীকরণ করিয়ে যাচ্ছেন ইনস্টিটিউট থেকে? আর কী করেই বা তা করা সম্ভব হচ্ছে? এ ব্যাপারে প্রমোদদয়ালবাবুর বক্তব্য, যে কেউ এসেই সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ করিয়ে যেতে পারেন। তার জন্য ৪ হাজার টাকা দিলেই হবে। কে পুনর্নবীকরণ করাতে আসছেন, তিনিই আসল সদস্য কি না, এত কিছু খতিয়ে দেখার মতো পরিকাঠামো ইনস্টিটিউটের নেই বলেই তাঁর দাবি। প্রমোদদয়ালবাবু বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা ছাড়াও গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত জুড়ে মোট ২১ হাজার ৬৯২ জন সদস্য রয়েছেন। এত জনের সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ রাখা সম্ভব নয়।’’ তিনি জানান, এর আগে এমনও হয়েছে যে, সদস্য মারা যাওয়ার পরেও দু’বছর ধরে তাঁর আত্মীয়েরা সেই সদস্যপদ পুনর্নবীকরণ করিয়ে গিয়েছেন! পরে জানাজানি হতে অবশ্য সেই সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও প্রাণকুমারবাবুর পরিবারের পক্ষ থেকে যদি তাঁর অসুস্থতার কথা জানানো হতো, তা হলে তাঁর সদস্যপদ আর পুনর্নবীকরণ করা হতো না বলে দাবি করেছেন প্রমোদদয়ালবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy