নিজস্বী: শিবরাত্রি উপলক্ষে কপালে চন্দনের তিলক ও সিঁদুরের টিপ পরে নয়া সাজ। শুক্রবার নিমতলা এলাকায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
এ তো তুমি কেমন তুমি, বলাই যায় তাঁকে দেখে?
নিছকই ফুটপাতের ধারে লিঙ্গরূপ পাথরটুকু নন। রীতিমতো সুঠাম জটাধারী মূর্তি। নন্দলাল বসুর হর-পার্বতীর ক্যানভাসের নাদুসনুদুস গেরস্ত শিবের সঙ্গেও মিল নেই তাঁর। পাল্টে গিয়েছে পুজোর স্তবও।
একদা কলকাতার কোনও পুরনো পাড়ার শিবমন্দিরেও সমস্বরে শোনা যেত, ‘বাবার শিঙা বাজিছে বোঁ বোঁ ভম ভম / শিরে করিছে গঙ্গা কল কল কল / চরণ চাপেতে ধরা টল মল মল / মৃদঙ্গ ধরে তাল তাথম তাথম / নাচে পাগলা ভোলা বাজে বম বম বম!’ তার বদলে এখন তারস্বরে পেল্লায় ডিজে বক্সের ভক্তিরস। ওঁ নমো শিবায় নমো শিবায়, হর হর ভোলে নমো শিবায়...
আরও পড়ুন: ভাষার আবেগে ‘জিরো পয়েন্টে’ উধাও কাঁটাতার
হাওড়া থেকে বড়বাজার তো বটেই, গড়িয়া থেকে দমদম জুড়েই শুক্রবার এমন শিবভক্তি ঘনিয়ে উঠেছে। বঙ্গললনার ভোরে শিবপুজোর বেলা নিয়ে আবেগের ছোঁয়াচ রবীন্দ্র-কবিতাতেও ভরপুর। কিন্তু মেট্রোয় সাজদুরস্ত আধুনিকার কপাল ছেয়ে মোটা তিলকের চিহ্ন অনেকেরই অচেনা। পেশিবহুল পুরুষ শিবের পোস্টার সেঁটে বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের জোড়হস্ত শুভেচ্ছা-বার্তার ছবিটিও বিরল দৃশ্য। ভবানীপুরে, গড়িয়ায় ফুটপাতের দোকানের খোপে গজিয়ে ওঠা মন্দিরে দক্ষিণার দাবিতে সরব এক ঝাঁক ভক্তিমতী। হিন্দি ও বাংলায় লেখা শিব ভক্তিসূত্রের পুস্তিকাও বিকোচ্ছে। ‘‘এ তো গানের জগঝম্পে মেতে ডিজ়াইনার ভক্তি!’’— হাসছেন প্রবীণ পুরোহিত শম্ভুনাথ স্মৃতিতীর্থ। ‘‘শিব কিন্তু খুব অল্পেই সন্তুষ্ট হন!’’— বলছিলেন তিনি। ‘বেলপাতা নেয় মাথা পেতে, গাল বাজালে হয় খুশি / মান অপমান সমান যে তাঁর, তাঁর কাছে নয় কেউ দোষী’! শিবরাত্রির ব্রত কথার বইয়ের ব্যাধের গল্প আজও অনেকের মুখে ঘোরে। ব্যাধ একবার মাংস নিয়ে ফেরার পথে জঙ্গলে ভরসন্ধ্যায় বেল গাছের উপরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গাছের নীচে শিবলিঙ্গ। ব্যাধের চাপে গাছ থেকে একরাশ পাতা এসে পড়ল শিবের মাথায়। ব্যাধের মৃত্যুর পরে এই এক পুণ্যেই যমদূতকে ফিরে যেতে হয়েছিল। ব্যাধের ঠাঁই হল সটান শিবলোকে। অল্পে সন্তুষ্ট শিবকে নিয়ে এত মাতামাতি বাঙালির এক ধরনের স্বধর্মচ্যুত হওয়া বলেই মনে করছেন শম্ভুনাথবাবু। ‘‘দুধ, দই, ঘি মধু মাখিয়ে বেলপাতা, গঙ্গাজল দিলেই তো দিব্যি শিবপুজো হয়। বাকি সব বাড়াবাড়ি। অনেক বিকৃতি ঢুকছে,’’ বলছেন তিনি।
তবে শিব আদতে বৈদিক দেবতাই নন! কিন্তু তাঁকে এ ভাবে মহা ধুমধামে পুজোর আতিশয্যে এক ধরনের ছাঁচে ঢালা ধর্মের রমরমাও দেখছেন কেউ কেউ। ধর্ম-সংস্কৃতি বিষয়ক প্রাবন্ধিক জহর সরকার মনে করাচ্ছেন, ‘‘বেদে লিঙ্গপুজো অনার্যদের কাণ্ড বলে গালমন্দই করা হয়েছে। শিব যে দেবতাদের মহলে ব্রাত্য, তা পুরাণের দক্ষযজ্ঞের গল্পেও স্পষ্ট।’’ সেই শিব পরে প্রলয়ের দেবতা মহেশ্বর রূপে উন্নীত হলেও তাঁর কিছু লোকায়ত মেজাজ বাঙালির বড় প্রিয় ছিল। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের মধ্যেও শিবরাত্রিতে মাংসভোজনের রীতি। শিবরাত্রির এই বাংলায় উমার বর সেই নেশাখোর ভাঙড় ভিখারি শিবের কোথাও দেখা মেলেনি। জহরবাবুর কথায়, ‘‘আজকের রাজনীতিতে প্রকট এক ঢালা হিন্দুত্বে এক ধরনের নিরামিষাশী শুদ্ধ ভক্তিরই ছক। শিবকেও ওরা সেই ছকে ফেলে দিল। সব বৈচিত্রের দফা রফা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy