Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

গার্ডেনরিচ থেকে কত নকশা পাকিস্তানে, হিসেব চায় দিল্লি

পেটের ভিতরে মজুত সারি সারি টর্পেডো। অতন্দ্র নজর দিগন্তবিস্তৃত দরিয়ায়। জলের তলা দিয়ে শত্রুপক্ষের কোনও ডুবোজাহাজ যদি চুপিসারে এগিয়েও আসে, তার নজর এড়াতে পারবে না।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:১১
Share: Save:

পেটের ভিতরে মজুত সারি সারি টর্পেডো। অতন্দ্র নজর দিগন্তবিস্তৃত দরিয়ায়। জলের তলা দিয়ে শত্রুপক্ষের কোনও ডুবোজাহাজ যদি চুপিসারে এগিয়েও আসে, তার নজর এড়াতে পারবে না। টর্পেডো দেগে নিমেষে সে গুঁড়িয়ে দেবে দুশমনকে।

তার নাম ‘কাডমাট।’ ভারতীয় নৌসেনার ভাণ্ডারে সাম্প্রতিকতম সংযোজন এই ডুবোজাহাজ বিধ্বংসী যুদ্ধজাহাজটি তৈরি হয়েছে গার্ডেনরিচের জাহাজ কারখানায় (জিআরএসই)। সেটি জলে ভেসেছে গত বৃহস্পতিবার, ঘটনাচক্রে যার তিন দিনের মাথায় রবিবার পুলিশের জালে পড়ে পাক গুপ্তচর হিসেবে অভিযুক্ত আসফাক-ইরশাদ-জাহাঙ্গির।

এবং জিআরএসই’র অন্দরে ওই চর-চক্রের ‘অবাধ গতিবিধি’র সংবাদও ক্রমে প্রকাশ্যে আসছে। যার সুবাদে আইএসআই এজেন্টরা জাতীয় প্রতিরক্ষা বিষয়ক নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ছবি পাকিস্তানে পাচার করতে পেরেছে বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ। এমনকী পাচার-তালিকায় কাডমাটের নক্‌শাও যে ছিল না, সে কথা গোয়েন্দারা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।

ফলে জিআরএসই ঘিরে আশঙ্কা-সংশয়ের বাতাবরণ ক্রমশ দানা বাঁধছে। সেনা সূত্রের খবর: আগামী ক’বছরে ভারতীয় নৌসেনার অন্যতম বল-ভরসা হয়ে উঠতে পারে, এমন বেশ কিছু জলযান এই মুহূর্তে সেখানে নির্মীয়মাণ। ‘‘সেগুলোর নকশা, ছবি বা তথ্য চরেদের হস্তগত হয়ে থাকলে জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে নিঃসন্দেহে বড় বিপদ,’’ মন্তব্য এক প্রতিরক্ষা-আধিকারিকের।

প্রকল্পগুলি কী কী?

জানা যাচ্ছে, শত্রু ডুবোজাহাজ নিকেশ করার জন্য (অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার) কাডমাটের মতো আরও দু’টো বিশেষ যুদ্ধজাহাজ গার্ডেনরিচে তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে আটটি ল্যান্ডিং ক্রাফ্‌ট ইউটিলিটি শিপ। সাদা বাংলায়, বড়মাপের যুদ্ধজাহাজ। যাতে চাপিয়ে ছোট মাপের ভেসেল বা সেনাবহরকে নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। আবার এখানেই বানানো হচ্ছে চার-চারটে অতি দ্রুতগামী অতিকায় জলযান— ওয়াটার জেড ফাস্ট অ্যাটাক শিপ। নৌবাহিনীর কাজে এরও ভূমিকা অপরিসীম।

অর্থাৎ মোট পনেরোটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ফৌজি জলযান। আগামী ক’বছরের মধ্যে গার্ডেনরিচ কারখানায় তাদের কলেবর ধারণ করার কথা। কিন্তু সেগুলোর নীল-নকশা চরদের হাত ঘুরে ইতিমধ্যে আইএসআই-ডেরায় পৌঁছে গিয়েছে কিনা, এমতাবস্থায় তা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করার নির্দেশ দিয়েছে নয়াদিল্লির প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। বস্তুত রণতরীর আঁতুড়ে বিদেশি চরের আনাগোনার খবর জিআরএসই-র বিশ্বাসযোগ্যতায় জব্বর ঘা দিয়েছে বলে মনে করছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তারা। সংস্থার বড়সড় আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাও তাঁরা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।

কী রকম? মন্ত্রক সূত্রের ব্যাখ্যা: গত বছর মরিশাসে ‘বারাকুডা’ নামে একটি যুদ্ধজাহাজ রফতানি করেছিল ভারত। সেটা গার্ডেনরিচে তৈরি হয়েছিল। তার নকশা পাচার হয়ে থাকলে জিআরএসই-র ভাবমূর্তি জোর ধাক্কা খাবে। মার খাবে ব্যবসা। ‘‘ফিলিপিন্সের যুদ্ধজাহাজ নির্মাণেরকয়েক হাজার কোটি টাকার বরাত হাসিল করতে গ্লোবাল টেন্ডারে সামিল হওয়ার যোগ্যতাও গার্ডেনরিচ অর্জন করেছে। কিন্তু এই সব কাণ্ড দেখে ম্যানিলা যদি নাম ছেঁটে দেয়, তা হলে দোষ দেওয়া যায় না,’’ মন্তব্য সূত্রটির। উপরন্তু ১৭ আলফা প্রকল্পে ‘ফ্রিগেট’ (এক জাতীয় যুদ্ধজাহাজ) তৈরির জন্য গার্ডেনরিচকে ২০ হাজার কোটি টাকার বরাত দিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী, যা কিনা এ যাবৎকালে জিআরএসই-র পাওয়া সবচেয়ে বড় বরাত। চর-কাণ্ডের জেরে তারও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

চক্রীদের কাজ-কারবার সম্পর্কে আর কী জানা গেল?

গোয়েন্দা সূত্রের দাবি: ধৃতদের জেরায় নিত্য-নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। জানা গিয়েছে, করাচি থেকে ইরশাদ-আসফাকদের নিয়মিত ফোন করতেন আইএসআইয়ের দুই অফিসার— কর্নেল আমির ও মেজর সেলিম। কোথা থেকে কী কী নথিপত্র হাতাতে হবে, তার নির্দেশ দিতেন। গার্ডেনরিচে পাওয়া তথ্য-নকশা পাকিস্তানে পাঠানোর বন্দোবস্ত করত ঢাকার পাক হাইকমিশনের এক ‘দাড়িওয়ালা’ কর্মী। এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘আসফাক দু’দফায় ঢাকা গিয়ে ওই ব্যক্তিরই হাতে কাগজপত্র পৌঁছে দিয়েছিল।’’

পাশাপাশি লালবাজারের খবর: ধৃত বাবা-ছেলে, অর্থাৎ ইরশাদ-আসফাক বলেছে, গোড়ায় করাচি থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত ইরফান আনসারি (ইরশাদের সেজ দাদা)। ২০০৫-এর শেষাশেষি কর্নেল আমির সরাসরি কথা বলতে শুরু করেন। ফোনটা অবশ্য ইরফানই করত। কী ধরনের নথি লাগবে জানতে চাইলে ও-পার থেকে নির্দেশ আসত, নৌবাহিনী ও যুদ্ধজাহাজ সংক্রান্ত যে কোনও তথ্যই স্বাগত।

২০১০-এ কর্নেল আমিরের জায়গা নেন মেজর সেলিম। আসফাকের দক্ষতাকে তিনি তারিফ করতেন। গোয়েন্দাদের দাবি: মেজরের নির্দেশেই আসফাক ২০১৩-র গোড়ায় ও শেষে দু’বার ঢাকা গিয়েছিল। জেরায় আসফাক জানিয়েছে, ঢাকায় সে উঠেছিল ইরফানের ভাড়াবাড়িতে— ঢাকা বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশায় মিনিট কুড়ির পথ। সেখানেই ‘দাড়িওয়ালা’র সঙ্গে তার মোলাকাত। মেমরি চিপের ৯০টি ছবি ও কিছু দস্তাবেজ তার হাতে তুলে দেয় আসফাক। সে জানিয়েছে, তাকে ঢাকার পাক হাইকমিশনেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে বেশ কিছু অফিসারের সঙ্গে তার কথা হয়।

সব মিলিয়ে করাচির চর-চক্র মজবুত হাতেই বাসা বুনেছিল কলকাতায়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা বুঝে উঠতে পারছেন না, ইজাজ-ইরশাদ-আসফাকের মতো গুপ্তচরদের আর কত মডিউল মহানগর বা আশপাশে ঘাপটি মেরে রয়েছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE