রাজ্য কৃষি দফতরের যুগ্ম সচিব গোদালা কিরণকুমারের বিরুদ্ধে অবশেষে ফৌজদারি মামলা শুরুর অনুমতি দিল কেন্দ্রীয় সরকার। বছর দেড়েক আগে শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) চিফ এগ্জিকিউটিভ অফিসার (সিইও) থাকাকালীন ওই আইএএস অফিসারের বিরুদ্ধে ৬০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় পুলিশ চারটি এফআইআর রুজু করেছিল। নবান্নের খবর, তারই একটিতে (৩১৮/১৩) ফৌজদারি মামলা শুরুর অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রের কর্মিবর্গ, জন অভিযোগ ও পেনশন মন্ত্রক, যাতে গোদালা অন্যতম অভিযুক্ত।
কোনও আইএএস অফিসারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু করতে হলে কেন্দ্রের অনুমতি লাগে। কিরণকুমারের ক্ষেত্রে সে অনুমতি এলেও রাজ্য সরকার এ বার কী ভাবে তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়, সে ব্যাপারে প্রশাসনের অন্দরেই কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। ‘‘এত বড় অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার গোদালাকে একটা দফতরের যুগ্ম সচিব করে রেখেছে! ফলে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে কৌতূহল থাকা তো স্বাভাবিক!’’— মন্তব্য নবান্নের এক আধিকারিকের।
প্রসঙ্গত, এসজেডিএ দুর্নীতি মামলায় গোদালার পাশাপাশি শাসকদলের কিছু পদাধিকারীরও নাম জড়ায়। আঙুল ওঠে সংস্থার অপসারিত চেয়ারম্যান তথা শিলিগুড়ির তৃণমূল বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য, এসজেডিএ-র বোর্ড সদস্য তথা জলপাইগুড়ির তৃণমূল সভাপতি চন্দন ভৌমিক ও শিলিগুড়ি পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর রঞ্জন শীলশর্মার দিকে। পুলিশ তাঁদের এক প্রস্থ জেরাও করে। এবং রাজ্য প্রশাসনের একাংশের ধারণা, এসজেডিএ-কাণ্ডকে প্রচারের আলোয় এনেই বামফ্রন্ট শিলিগুড়িতে পুরবোর্ড গঠনের দোরগোড়ায় পৌঁছতে পেরেছে। তৃণমূলের এক রাজ্য নেতারও স্বীকারোক্তি, ‘‘এসডেজিএ-দুর্নীতির আঁচে শিলিগুড়ির পুরভোটে আমরা পিছিয়ে পড়েছি।’’
পাশাপাশি ওই মামলায় গোদালার গ্রেফতারি ঘিরেও তখন প্রশাসনিক মহলে কম জলঘোলা হয়নি। ২০১৩-র ডিসেম্বরে এফআইআরের ভিত্তিতে পুলিশ যখন গোদালাকে গ্রেফতার করে, তখন তিনি মালদহের জেলাশাসক। কেন নবান্নের শীর্ষ মহলের অনুমতি না-নিয়ে এক জন ডিএম’কে গ্রেফতার করা হল, সেই প্রশ্ন তুলে শিলিগুড়ির তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কারলিয়াপ্পন জয়রামনকে রাতারাতি বদলি করে দেয় সরকার। এমনকী, রীতিমতো সাংবাদিক বৈঠক ডেকে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র পুলিশি সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনাও করেন। ‘‘যদি এমন সম্ভাবনা থাকে যে, অভিযুক্ত পালিয়ে যাবেন কিংবা সাক্ষীদের প্রভাবিত করবেন, তা হলেই তাঁকে গ্রেফতার করা উচিত। গোদালার ক্ষেত্রে এর কোনওটাই প্রযোজ্য নয়।’’— দাবি করেছিলেন মুখ্যসচিব।
এর পরেই জয়রামনকে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে (পদ নেই, কাজও নেই) পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এক রাত হাজতে কাটিয়ে গোদালাও জামিন পেয়ে যান।
জয়রামন অবশ্য দমে যাননি। কম্পালসরি ওয়েটিংয়ে থাকাকালীন তিনি নিয়ম মেনে হাজিরা দিয়েছেন পুলিশ অফিসে। কিন্তু এসজেডিএ-মামলা সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ মহলেও মুখ খোলেননি। এবং তাঁরই শুরু করা তদন্তকে কেন্দ্র মান্যতা দিয়েছে— এ কথা জেনেও তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। গোদালাও এ প্রসঙ্গে মন্তব্য এড়িয়েছেন। মামলাটির তদন্ত করছে যারা, সেই সিআইডি-র এক কর্তার কথায়, ‘‘নবান্ন থেকে আমাদের মৌখিক ভাবে জানানো হয়েছে। তবে ফৌজদারি মামলা শুরুর অনুমতিপত্র হাতে পাইনি।’’
এসজেডিএ-তে হয়েছিলটা কী ?
ঘটনার বিববরণ দিয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে যে চিঠি জয়রামন লিখেছিলেন, মহানন্দা অ্যাকশন প্ল্যানে নিকাশি নির্মাণ এবং বাগডোগরা-মালবাজার-ময়নাগুড়ি শ্মশানে বৈদুতিক চুল্লি বসানোর জন্য ২০১২-র ২৭ অগস্ট থেকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সাত দিনের নোটিসে কলকাতার এক ঠিকাদার সংস্থাকে বরাত দিয়েছিল এসজেডিএ। তদন্তে নেমে পুলিশ জেনেছে, সংস্থাটি একাই ১২০ কোটি ৮০ লক্ষ টাকার বরাত পায়। এমনকী, মালপত্র সরবরাহ করার আগেই তাদের ৫৩ কোটি ৮৩ লক্ষ টাকার বিল মিটিয়ে দেওয়া হয়।
দুর্নীতির ‘গভীরতা’ যে কতখানি, সরকারি নথি ঘেঁটে তারও হদিস মিলেছে বলে ডিজি’কে জানিয়েছিলেন জয়রামন। দাবি করেছিলেন, বহু ক্ষেত্রে ঠিকাদার সংস্থার টেন্ডারে হাঁকা দরই বরাত দেওয়ার সময়ে তিন-চার কোটি টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন, শ্মশানে একটা চুল্লি বসাতে ঠিকাদার যেখানে ১৩ কোটি ৭৭ লক্ষ চেয়েছে, ফাইলে সেটাই বাড়িয়ে লেখা হয়েছে ১৬ কোটি ৯৭ লক্ষ। একই ভাবে নিকাশির খরচ ৬৫ কোটি ৯৭ লক্ষ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৯ কোটি ৮৭ লক্ষ। এবং ওই একই কৌশলে বড় কাজ ভাগ ভাগ করে দেখিয়ে দরে কারচুপি করা হয়েছে।
কিন্তু দরপত্র তো ডাকা হয়েছিল অনলাইনে! সেখানে কারচুপির সুযোগ কোথায়? পুলিশি তদন্ত বলছে, টেন্ডার জমা করার সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটটি দেখভালের ভার একটি সংস্থাকে দেওয়া হলেও সাইটে ঢোকার পাসওয়ার্ড দু’-এক জন জানতেন। তার দৌলতে আগাম জানা যেত, টেন্ডারে কে কত দাম হেঁকেছে। সেই মতো এক শ্রেণির ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্যে দরে হেরফের ঘটিয়ে পছন্দের ঠিকাদারকে একচেটিয়া বরাত দেওয়া হয়েছিল বলে ডিজি’কে জানিয়েছিলেন শিলিগুড়ির তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার জয়রামন।
এসজে়ডিএ-মামলার তদন্তভার সিআইডি হাতে নেওয়ার পরে কাজ কিন্তু বিশেষ এগোয়নি। এখন কী হয়, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy