—প্রতীকী ছবি।
১৫ লক্ষ টাকা চাই! নিজের গবেষণাপত্র জমা করতে পারার ‘অনুমতি’ বাবদ দিতে হবে এর কিছুটা। বাকিটা চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাশ করার ‘ফি’।
না দিলে?
‘দেখে নেওয়া হবে’!
এই ‘দেখে নেওয়ার’ ফলই কি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনা?
তদন্ত ভার হাতে আসার তিন সপ্তাহ পরে এখন এমনই তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে আসছে বলে সিবিআই সূত্রের দাবি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, তারা জেনেছে, এই টাকা দিতে রাজি হননি মৃতা। অভিযোগ, তাই গত এক বছর ধরে তাঁকে নানা ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছিল হাসপাতালে ডিউটি দেওয়ার সময়ে। এবং সেই কারণেই ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুদের তিনি জানিয়েছিলেন, ডিউটি করতে ভাল না লাগার কথা। সূত্রের খবর, এখানে আটকে না থেকে ওই তরুণী পাল্টা বলেছিলেন, ‘উপরমহলে’ সবটা লিখিত ভাবে জানাবেন।
তদন্তে জানা গিয়েছে, বিষয়টি নাকি ‘সামলে নেওয়া’র নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল হাসপাতালেরই কয়েক জনকে। তাঁরা কারা? কে-ই বা নির্দেশ দিয়েছিলেন? ‘উপরমহল’ বলতেই বা কাদের বোঝানো হয়েছে? স্পষ্ট উত্তর মেলেনি। এ ব্যাপারেই নিশ্চিত তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের কাজ এখন জোর কদমে চলছে বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রের দাবি।
এক সিবিআই অফিসার বলেন, ‘‘অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ সামনে আসছে। ফলে আদালতগ্রাহ্য প্রমাণ সংগ্রহ না হওয়া পর্যন্ত পদক্ষেপ করা মুশকিল। তবে এই প্রমাণ জোগাড় করতে নেমেই বার বার ধাক্কা খেতে হচ্ছে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে। সে রাতে ঠিক কী ঘটেছিল, সেটাই গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।’’ সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতেই সামনে আসছে, সে রাতে আর জি করের জরুরি বিল্ডিংয়ে উপস্থিত থাকা কয়েক জনের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। তাঁদের ফোন থেকে পাওয়া কিছু তথ্য এবং ভিডিয়ো এ ক্ষেত্রে তদন্তকারীদের সাহায্য করছে বলে সূত্রের খবর। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে দাবি, এর মধ্যে মৃতার এক সহপাঠীর ফোন থেকেই মিলেছে টাকা দাবি করার এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
তবে ঠিক কী ঘটেছিল সে রাতে? এখনও পর্যন্ত সিবিআই যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, তা হল— সে রাতের ঘটনা জরুরি বিল্ডিংয়ের দোতলার বার্ন ইউনিট থেকে ছ’তলার জেনারেল মেডিসিন বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর মধ্যে চতুর্থ তলের সেমিনার রুম, অর্থাৎ যেখান থেকে মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, সেই জায়গা আর পঞ্চম তলের অস্থি-শল্য বিভাগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সূত্রের খবর, একাধিক সিসি ক্যামেরার ফুটেজ এবং এখনও পর্যন্ত জেরা করা প্রায় সাড়ে তিনশো জনের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই দুই তলের মধ্যেই সে রাতে ১২টার পর থেকে একাধিক বার যাতায়াত করতে দেখা গিয়েছে নির্যাতিতা ওই তরুণী চিকিৎসককে। সে রাতে চার তলা থেকে ছ’তলার মধ্যে, অর্থাৎ ঘটনাস্থলের আশপাশে কর্মরত ছিলেন চার জন রেসপিরেটরি কেয়ার ইউনিট টেকনিশিয়ান। প্রত্যেকেই পুরুষ। ছিলেন ১২ জন ‘ওয়ার্ড মাসি’। রেফার হওয়া রোগীর কাগজ, মৃত্যুর শংসাপত্র, ভর্তির টিকিট-সহ নানা জরুরি নথি নিয়ে যাতায়াত করেছেন অন্তত সাত জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। মহিলা এবং পুরুষ মিলিয়ে নার্সিং স্টাফ ছিলেন সাত জন। এ ছাড়া সাত জন ইন্টার্ন, হাউস স্টাফ এবং পিজিটি (স্নাতকোত্তর স্তরের চিকিৎসক পড়ুয়া) প্রায় সারা রাতই যাতায়াত করেছেন এই দুই তলের মধ্যে।
সূত্রের খবর, জেরায় এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী দাবি করেছেন, নির্যাতিতাকে রাত ১১টা নাগাদ এক তলার জরুরি বিভাগ থেকে উপরের দিকে যেতে দেখেছেন তিনি। আর এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর দাবি, এই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া সঞ্জয়কেও তিনি দেখেছেন সেমিনার রুমের দিকে যেতে, রাত ১১টার আশেপাশে। ওই সময়ের সঞ্জয়ের ছবি চতুর্থ তলের সিসি ক্যামেরাতেও ধরা পড়েছে। তবে কেউই সঞ্জয়কে সেমিনার রুমে ঢুকতে দেখেছেন বলে দাবি করেননি। যদিও সে রাতে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ তলের লবিতে দেখা গিয়েছে সঞ্জয়কে। এক নার্স আবার দাবি করেছেন, ঘটনাস্থল অর্থাৎ সেমিনার রুমে যাওয়ার পথে নার্সিং স্টেশনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সে রাতে ওই নার্সিং স্টেশনে তিন জন নার্স ছিলেন। রাতের ডিউটিতে তাঁদের কেউই বিশ্রাম করেন না। সেই রাতেও সবাই জেগে ছিলেন। তদন্তকারীদের দাবি, তাঁরা জেনেছেন, নার্সদের কেউই রাত সাড়ে ৩টে পর্যন্ত ওই তরুণী চিকিৎসককে সেমিনার রুমের দিকে যেতে দেখেননি। তবে কি সেমিনার রুমে বসে রাত ২টো নাগাদ খাওয়ার এবং অলিম্পিকে ‘জ্যাভলিন থ্রো’ দেখার দাবি ঠিক নয়?
পঞ্চম তলের অস্থি-শল্য বিভাগের এক নার্সের দাবি, রাত সাড়ে ৩টে নাগাদ নির্যাতিতাকে তিনি ওই তলে দেখেছেন। সেখানে আরও কয়েক জন ছিলেন। এর পর ওই তরুণী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে খবর পান তিনি। তাঁকে কোনওমতে নিয়ে গিয়ে সেমিনার রুমে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি শুনেছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু তাঁকে সেমিনার রুমে নিয়ে যেতে কেউ দেখেছেন বলে দাবি করেননি।
রহস্য তৈরি হয়েছে হাসপাতালের ভিতরের দিকের ছোট লিফট নিয়েও। এমনিতে এই লিফট জরুরি বিল্ডিংয়ের এক তলা থেকে উপরের তলগুলির মধ্যে দিনের বেলা যাতায়াত করে। মূলত চিকিৎসক এবং চিকিৎসাকর্মীরা এটি ব্যবহার করেন। চতুর্থ তলে এই লিফট খোলে নার্সিং স্টেশনের মধ্যে। লবি দিয়ে এসে নার্সিং স্টেশন দিয়েই যেতে হয় সেমিনার রুমের দিকে। এক নার্সের দাবি, সেই রাতে নাকি কোনও এক জরুরি কারণে নার্সিং স্টেশনের মধ্যে থাকা সেই লিফট চালু করা হয়েছিল। এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মীও জেরায় দাবি করেছেন, ওই লিফট নাকি জরুরি কোনও রোগীকে নামানোর জন্য চালু করা হয়েছিল। সেই রোগী কে? এখনও হদিস মেলেনি।
প্রশ্ন উঠছে, অস্থি-শল্য বিভাগে ওই তরুণী কী করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন? লিফট দিয়ে কি তবে তাঁকেই নামানো হয়েছিল? তার পরে কী হল?
এখানেই সেই রাতে হাসপাতালে উপস্থিত এক স্নাতকোত্তর চিকিৎসক পড়ুয়ার বক্তব্যে নতুন ইঙ্গিত মিলেছে বলে সিবিআইয়ের তদন্তকারীদের সূত্রে দাবি। ওই পড়ুয়া জানিয়েছেন যে, চতুর্থ তলের সেমিনার রুমই একমাত্র বিশ্রামের জায়গা নয়। পিজিটি, ইন্টার্ন বা হাউস স্টাফেরা অনেকেই ওই তলেই পলিসোমনোগ্রাফি রুমে বিশ্রাম করেন। এই ঘরটিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। যে হেতু ঘুমের মধ্যে এই পরীক্ষা করা হয়, তাই একে ‘স্লিপ রুম’ বলে থাকেন তাঁরা। ওই ঘর সেই রাতে সাড়ে ৩টের পর থেকে তালা দিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই ঘর এর পরে খোলা হয় পাশের একটি ঘর হঠাৎ করেই নির্মাণের নামে ভাঙা শুরু হওয়ার সময়ে। তবে কি এই সমস্ত ঘরে আলাদা কোনও সূত্র রয়েছে, উঠছে প্রশ্ন।
আপাতত এই সমস্ত তথ্যপ্রমাণ মিলিয়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে চাইছেন সিবিআইয়ের তদন্তকারীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy