মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র
ঝিমধরা বাড়ির ডোর বেল বাজাতে দোতলা থেকে উঁকি দিলেন নিজেই। ‘একটু দাঁড়ান’ বলে ভিতরে গেলেন। কিছু ক্ষণ পরে নীচে নেমে উঠোনে রাখা ধুলোমাখা জীর্ণ টেবিলের সামনের বেঞ্চে বসতে বসতে বললেন, ‘‘রান্নার মাসি আসেনি। তাই রান্না করছিলাম।’’
প্রচারে বেরোলেন একেবারে পড়ন্ত বিকেলে। গাড়ি ছুটল বেশ দূরের জিনগাঁও-য়ের পথে। পাঁচিলঘেরা স্কুলমাঠে ছোট্ট মঞ্চে উঠলেন এই স্কুল-দিদিমণি। সামনে জনা পঞ্চাশ লোক। সাঁঝ-আঁধারে দিদিমণি বোঝাচ্ছেন, ‘‘সাম্প্রদায়িকতা আর তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপনাদের পাশে থাকব। আমাকে হাত চিহ্নে ভোট দেবেন।’’ ‘হাত’-এ ভরসা রাখার আবেদনে বাম-কংগ্রেস জোটের হয়ে কংগ্রেস প্রার্থী ধীতশ্রী রায় বলে চলেন, ‘‘আপনারাই আমার বাবা প্রমথনাথ রায়কে চার বার জিতিয়েছেন। বাবার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাব আমি।’’
তাঁর কাচ ঢাকা গাড়ি এ বার বাড়িমুখো। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ফতেপুর, তরঙ্গপুর, দিলালপুরের দু’ধারে, কুঁড়ের মাচায়, আলপথে শুধুই পদ্ম আর ঘাসফুল। ‘হাত’ চোখে পড়ে না হাত-প্রার্থীরই। পাঁচ বছর আগে রায়গঞ্জ লোকসভায় (এই কেন্দ্রেরই একটি বিধানসভা কালিয়াগঞ্জ) জিতলেও শেষ লোকসভায় তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছে সিপিএম। ২০১৪-র ভোটে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেস গত লোকসভায় চতুর্থ। এখন জোট থাকলেও বামের দেখা নেই পথে। তবুও কালিয়াগঞ্জের উপনির্বাচনের শেষলগ্নে ধীতশ্রী শোনান, এগিয়ে যাওয়ার আশা।
কংগ্রেসের আলো বলতে শুধু প্রয়াত প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির স্মৃতিটুকু। কিন্তু প্রিয়-হীন কালিয়াগঞ্জে এখন আর ‘হাত’ ধরার তেমন ‘মন’ নেই। অথচ স্বাধীনতার পরে ১১ বার হাতেই ভরসা রেখেছিল এই কালিয়াগঞ্জ। কয়েক বার জিতেছে সিপিএম।
হাত-বামের এই আপাত ‘ফাঁক’ গলে পঞ্চায়েত ভোট থেকেই একটু একটু করে পদ্ম ফুটেছে উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের গঞ্জ-গ্রামে। দশটি পঞ্চায়েতের মধ্যে ন’টিই এখন পদ্ম-দখলে। আর গত লোকসভা ভোটে রায়গঞ্জ জিতেছে বিজেপি-ই। প্রায় দু’লক্ষ ভোটারের কালিয়াগঞ্জে কোনও দিনই জেতেনি ঘাসফুল।
তবুও লোকসভায় পদ্ম-প্রার্থীর থেকে এই বিধানসভা কেন্দ্রে ৫৬ হাজার ৭৬২ ভোট কম পেয়েও এখানে দ্বিতীয় তৃণমূলই।
লোকসভা ভোটের পর এনআরসি-আতঙ্কে কিছুটা হলেও হাওয়া ঘুরেছে সীমান্তবর্তী কালিয়াগঞ্জে। ২০%-র কাছাকাছি সংখ্যালঘু ভোট এখানে। এলাকায় ঘুরে বোঝা যায়, এনআরসি আতঙ্কে সংখ্যালঘুদের অনেকেরই ভরসা বাড়ছে তৃণমূলে। সংখ্যালঘুদের কাছে টানতে মরিয়া ঘাসফুলও। সীমান্ত লাগোয়া ফরিদপুরের চায়ের দোকানে গোলাম মুস্তাফা বলেই দিলেন, ‘‘আমাদের গ্রামে অনেকেরই ’৭০ সালের আগের জমির কাগজ নেই। লোকসভায় বিজেপি এই গ্রামে ভোট পেয়েছিল। তাও বলছে এনআরসি করে তাড়িয়ে দেবে! এ বার তাই তৃণমূলকেই ভোট দেব।’’
ছোট ছোট জটলায় রাজবংশী ভাষায় তৃণমূল প্রার্থী তপন দেবসিংহ বলছেন, ‘‘দেশত থাকিবার চান তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁচান। তৃণমূলকো ভোট দেন।’’ বোঝাচ্ছেন, ২০২১-তে রাজ্যের মসনদে মমতা থাকলে রাজ্যে এনআরসি বলবৎ হতে পারবে না। প্রায় ৫০% রাজবংশীর বাস এখানে। লোকসভায় রাজবংশীদের অনেকেই যে পদ্মে ভরসা রেখেছিল, তা স্বীকার করেই তৃণমূলের প্রাক্তন রাজবংশী সাংসদ পার্থপ্রতিম রায় গ্রামে গিয়ে বোঝাচ্ছেন, ‘‘বিজেপিকে দূরে সরিয়ে তৃণমূলকে তখতে রাখুন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনআরসি হতে দেবেন না এখানে। পরে বুঝবেন, আপনারা ভুল করেননি।’’
গ্রামে কিছুটা বোঝাতে পারলেও শহরের হাজার পঞ্চাশ ভোটের অনেকটাই যে পদ্ম-শিবিরে ঘুরে গিয়েছে, মানছেন ঘাসফুলের নেতারা। তাই হুডখোলা জিপে ঘোরার ফাঁকেই তপন স্বীকার করে নেন, ‘‘এনআরসি-আতঙ্কে অনেকেই আমাদের দিকে ফিরে আসবেন, বুঝতে পারছি। লড়াই কঠিন। তবে এ বার ভোটের মার্জিন অনেকটাই মেরামত করতে পারব।’’
লোকসভার নিরিখে তাঁর দল এগিয়ে, তবু কাকভোর থেকে সাদা পাঞ্জাবি, খেটো ময়লা ধুতি, ধুলোমাখা চপ্পলে গ্রামের পর গ্রামে দোরে দোরে ঘুরছেন পদ্ম-প্রার্থী কমল সরকার। তাঁর নামেও পদ্ম, প্রতীকেও পদ্ম। উত্তর দিনাজপুরের জেলা পরিষদে এই কমলই একমাত্র বিজেপি-সদস্য। ভেলাই হাটে দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, ‘‘ন’বছর বয়স থেকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে পুতুলনাচ দেখিয়েছি। লোক-গান করতাম। নিজে চাষ করি। আমি রাজবংশী। জানি এখানে রাজবংশীরা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই আছে।’’
পদ্ম-হাওয়ার শক্তি বাড়াতে একের পর এক বিজেপি সাংসদ, কেন্দ্রীয় নেতা ঘুরছেন কালিয়াগঞ্জে। বোঝাচ্ছেন, কোনও হিন্দু ভারতছাড়া হবেন না। তাঁদের কোনও তথ্যপ্রমাণ দেখাতেও হবে না। কিন্তু অনুপ্রবেশকারী সংখ্যালঘুদের এ দেশে ঠাঁই হবে না।
রাজবংশীদের কাছে টানতে কমল বোঝান, ‘‘রাজবংশীদের উন্নতি হয়নি। অনেক বড় বড় প্রকল্পের কথা রাজ্য সরকার বলে। কিন্তু সে সব সুবিধা, টাকা কোথায়? কেউ কিছু পান না। গ্রামে পাকা রাস্তা হয়নি, জলের আকাল রয়েই গেল।’’ শুনে দিলালপুরের বৃদ্ধা সারণ সরকার বলেন, ‘‘বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতার জন্য কত বার পঞ্চায়েত অফিসে গিয়েছি। কোনও টাকা পাই না।’’ চিলতে মুদির দোকানের দময়ন্তী দেবশর্মা ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, ‘‘লোকসভায় বদল হয়েছে। বিধানসভাতেও এ বার বদল দরকার। হাওয়া যে দিকে বইছে, সে দিকেই ভোট দেব আমরা।’’
উন্নয়ন না-পৌঁছনোর ক্ষোভ ‘অন্তরায়’ বুঝে ঘাসফুলের জন্য প্রকাশ্যেই ভোট ধার চাইছেন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। বলছেন, ‘‘ধার হিসেবে তৃণমূলকে ভোট দিন। জয়ী হলে ফল ঘোষণার ১৫ দিনের মধ্যে আপনাদের দাবি মতো উন্নয়নের কাজ শুরু করবে রাজ্য সরকার।’’ তাঁর কথা, ‘‘লড়াই করে দেখি না, কমলে কমল ফোটে, না তপন ওঠে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy