তালতলার কাছে জোড়া গোল খেল আমহার্স্ট স্ট্রিট।
চৌরঙ্গি উপনির্বাচনের ফল বিশ্লেষণের পর এটাই ক্যাচলাইন হওয়া উচিত। তিন মাস আগে লোকসভা ভোটে আমহার্স্ট স্ট্রিটের ‘ছোড়দা’ তালতলার ‘দাদা’র কাছে শুধু হারেনইনি, জামানতও খুইয়েছিলেন। কিন্তু তার মধ্যেও চৌরঙ্গি বিধানসভা এলাকায় ছোড়দার ‘লিড’ ছিল প্রায় দেড় হাজার ভোটে। উপনির্বাচনে দাদারা নিজেরা কেউ সরাসরি লড়াইয়ে ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু স্ত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে চৌরঙ্গি আসন তৃণমূলের ঘরে তুলে দিয়েছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দুই ভোট-যুদ্ধেই সুদীপবাবুর রণকৌশলের কাছে হার মানতে হয়েছে সোমেন মিত্রকে। স্কোরবোর্ড বলছে, সুদীপ ২ - সোমেন ০।
যদিও সুদীপবাবু যে তাঁকে দু’বার হারিয়ে দিলেন, এ কথা মানতে নারাজ সোমেনবাবু। তাঁর বক্তব্য, “এটা তো আমার ব্যক্তিগত হার নয়। কংগ্রেসের হার।” কেন হার, ওয়ার্ডভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ না করে সে ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে চান না সোমেনবাবু।
এ বারে চৌরঙ্গির ভোটটা ছিল কার্যত বৌদিকেন্দ্রিক। এক বৌদির ছেড়ে যাওয়া আসনে ফিরে এসেছেন অন্য বৌদি। সোমেনবাবুর স্ত্রী শিখা মিত্র চৌরঙ্গিতে পদত্যাগ করাতেই উপনির্বাচন করতে হয়েছে। শিখা বৌদি এ বার লড়েননি। তিনি যেমন কংগ্রেসের প্রার্থী হতে রাজি হননি, তেমনই বিজেপির আবেদনও ফিরিয়ে দেন। কিন্তু সিঙ্গাপুরের বিমান ধরার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করে নির্দেশ দেওয়া মাত্রই দলের অনুগত সৈনিক, সুদীপ-জায়া নয়না চৌরঙ্গিতে প্রার্থী হতে রাজি হয়ে যান।
শিখা মিত্র দাঁড়ালে ফলাফলে হেরফের হতো কি? তেমনটা মনে করছেন না সোমেন। কিন্তু তা হলে লোকসভার ভোটে যে চৌরঙ্গিতে সোমেনবাবু প্রায় দেড় হাজার ভোটে তৃণমূলের থেকে এগিয়ে ছিলেন, সেখানে তৃণমূল প্রায় ১৫ হাজার ভোটে জয়ী হল কী ভাবে? সোমেনবাবু ম্লান হেসে বলেন, “আমার অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে!” তবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর ব্যাখ্যা, “আমাদের প্রার্থী খুব খেটেছে ঠিকই। কিন্তু ধারে-ভারে এবং পরিচিতিতে সোমেনদার আলাদা গুরুত্ব বলেই লোকসভায় লিড পেয়েছিলেন।”
অধীরবাবুর এই বক্তব্য অনেকেই উড়িয়ে দিতে পারছেন না। কারণ লোকসভা ভোটে সোমেনবাবুর উপস্থিতিতে মুসলিম ভোট অনেকটাই কংগ্রেসের ঝুলিতে পড়েছিল। এ বার শিখা প্রার্থী না-থাকায় এবং কিছুটা বয়সের ভারে সোমেনবাবু পূর্ণ শক্তিতে প্রচারে নামেননি। এবং তা নিয়ে চাপানউতোর শুরু হয়েছে কংগ্রেস শিবিরে। সোমেনবাবুর দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন খোদ কংগ্রেসপ্রার্থী সন্তোষ পাঠক। যে অভিযোগ আবার উড়িয়ে দিয়েছে সোমেন-শিবির।
তৃণমূলের হিসেব বলছে, লোকসভা ভোটে তারা ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে এগিয়ে থাকলেও কংগ্রেস ৬২, ৬৪, ৪৬, ৪৪ এবং ৫২ নম্বর ওয়ার্ডে অনেক এগিয়ে ছিল। এর মধ্যে ৪৪, ৬২ এবং ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড মুসলিম অধ্যুষিত। কিন্তু এ বার সুদীপবাবুর নিপুণ পরিচালনায় ৪৪ এবং ৬২ নম্বর ওয়ার্ডেও কংগ্রেসের তুলনায় তৃণমূল এগিয়ে গিয়েছে। সোমেনবাবু অবশ্য এ ক্ষেত্রেও বলেছেন, ফলাফল পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ না করে তিনি কোনও মন্তব্য করবেন না।
সুদীপের নিজের বিশ্লেষণ কী বলছে? এই জয়ের পিছনে নয়নার কৃতিত্ব ও দলনেত্রীর জনপ্রিয়তাই কাজ করেছে বলে মনে করছেন সুদীপবাবু। কিন্তু কথায় কথায় এও স্বীকার করলেন, তাঁর ‘টিপস’ নয়নার কাজে লেগেছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তৃপ্তির হাসি হেসে সুদীপ বলেন, “আমি নয়নাকে বুদ্ধি দিয়েছিলাম, নিজে ঘরে ঘরে প্রচারে যাও। নির্বাচনে ভোটারের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।” নয়না চৌরঙ্গির ১১টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে পায়ে হেঁটে ঘরে ঘরে প্রচার করেছেন। তবে সুদীপ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘নয়না তো এই প্রথম ভোটে লড়ছে না! ও নিজেও ভোটে লড়াইয়ের কৌশল জানে।” ১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরি হওয়ার পরে বউবাজারের উপনির্বাচনে নয়না লড়েছিলেন। জিততে পারেনি। তার পর ২০০১ সালে জেতেন। আর এ বার তো ‘ছোড়দা’র ঘাঁটিতেই জয় ছিনিয়ে নিলেন তিনি।
শুধু চৌরঙ্গি নয়, একদা আর এক শক্ত ঘাঁটি বসিরহাটেও কংগ্রেস এ বার অনেকটা পিছিয়ে গিয়েছে। সেখানে জামানতও জব্দ হয়েছে তাদের। এই অবস্থায় কোন পথ ধরা হবে, তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে দলের অন্দরে। তাতে দু’টি মত উঠে এসেছে। একাংশের বক্তব্য, তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বামেদের হাত ধরা দরকার। অন্য মত হল, তৃণমূলের সঙ্গে জোটই ভবিতব্য। তাতে বিজেপি-রও মোকাবিলা করা যাবে, দলে ভাঙনও রোধ করা যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy