তিনি এক অন্য আরণ্যকের রচয়িতা। তাঁর অরণ্য দর্শন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে আলাদা। বিভূতিভূষণ যদি অরণ্য প্রকৃতিকে ঐশী মহিমায় দেখে থাকেন, তবে তিনি দেখেছিলেন প্রেমিকার মহিমায়। বুদ্ধদেব গুহ। বাংলা জনপ্রিয় সাহিত্যে এক নিঃসঙ্গ নাম। ‘নিঃসঙ্গ’, কেন না যে ধারার সাহিত্য তিনি রচনা করতে এসেছিলেন, যে লিখনকে তিনি আজীবন লিখে গিয়েছেন, তার সঙ্গে বাংলা মূলধারার সাহিত্যের সুর তেমন মেলে না।
অনেক পাঠক বুদ্ধদেবকে চেনেন শিকার কাহিনি বা অরণ্যপ্রেমিক লেখক হিসেবে। কিন্তু শিকার বা অরণ্যকে ছাপিয়ে তাঁর লিখন ধরে রয়েছে এক বিশেষ সত্তাকে, যার নাম ‘প্রেমিক’। সেই প্রেম একই সঙ্গে প্রকৃতি ও নারীর প্রতি ধাবিত। আর প্রায়শই তা মিলেমিশে একাকার। নারীকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না প্রকৃতি থেকে। অথবা তার বিপরীত।
গত কয়েক দশকে বিশ্ব সাহিত্যে ‘ইয়ং অ্যাডাল্ট’ নামে এক বিশেষ ধারা পরিলক্ষিত। এই ধরনের সাহিত্য ‘ইয়ং’-দের ‘অ্যাডাল্ট’ হয়ে ওঠার সহায়ক। আবার পরিণত পাঠকও কৈশোরে ফিরে যেতে চাইলে এমন সাহিত্যে ডুব দিতে পারেন। বাংলায় এমন ধারার অস্তিত্ব সে অর্থে বিরল। যে ক’জন হাতে গোনা সাহিত্যিক সেই রাস্তায় হেঁটেছেন, বুদ্ধদেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচনা পড়েই সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা কিশোর বয়ঃসন্ধিকে পেরিয়ে যুবক হওয়ার প্রথম পাঠ নিয়েছে। ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ মেয়েবেলার আর্তিকে যুবতীবেলায় উত্তরিত করেছে। আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গ সাহিত্যের বেশ কয়েক প্রজন্মের পাঠক বুকের মধ্যে ভালবাসার সবুজ অন্ধকারকে বনজ্যোৎস্নায় লালন করেছে তাঁর কলমেরই সুবাদে।
বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবন থেকে তাঁর সাহিত্যের ভুবন খানিকটা দূরে। টাঁড়ে, বনে, অরণ্যে, বাঘের গায়ের ডোরায় সে সব কাহিনি ছায়াময়। তাঁর নায়কদের নাম ঋজুদা, রুরু, পৃথু। নায়িকাদের নাম টিটি, টুঁই, কুর্চি। তারা ছাপোষা বাঙালি জীবনের চৌহদ্দিতে নেই। কিন্তু পাড়ার লাইব্রেরি থেকে সেই বই বুকে নিয়েই বাঙালি গৃহবধূ তাঁর নিঃসঙ্গ দুপুর কাটাতেন। লুকিয়ে ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ পড়তে পড়তে বাঙালি কিশোর বুকের ভিতরে যৌবনের প্রথম আলোড়ন টের পেত।কিশোরী নিজের অজান্তেই কখন যেন যুবতী হয়ে উঠত।
ঋজুদা ‘সাধারণ’ বাঙালি নয়। আবার ঘনাদা বা ফেলুদার চাইতে সে পুরোপুরি আলাদা। একদা শিকারি পরে অরণ্যপ্রেমিক এই নায়ক যেন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েও খানিকটা উপরে। ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’ বা ‘রুআহা’ আর যাই হোক, শিকার কাহিনি নয়। আবিশ্ব অরণ্য আর তার উপরে নির্ভর করে বেঁচে থাকা প্রাণী ও মানুষের এক আশ্চর্য জীবনপঞ্জি যেন এই দুই উপন্যাস। ঋজুদা এখানে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। আবার জীবনের কাছে সে মাথা ঝোঁকাতেও জানে। বাঙালি কিশোর জানত, ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শঙ্কর যেমন হওয়া যায় না, ঋজুদাও তেমনই হয়ে ওঠা যায় না। কিন্তু বুকের মধ্যে ঋজুদা থাকে। মানভূম থেকে আফ্রিকা— বিভূতিভূষণের অরণ্য সাহিত্যের উত্তরাধিকার হিসেবে সে বেঁচে থাকে। কাল তাকে সত্যচরণ আর শঙ্কর থেকে ঋজুদায় বদলে দেয়। শহুরে, দুর্দান্ত স্মার্ট এই ব্যক্তিটি যেন ‘আরণ্যক’-কে প্রণাম জানিয়ে তার নিজের ভুবন গড়ে নেয়।
সে ভাবেই ‘মাধুকরী’ বা ‘চাপরাশ’ মধ্যবিত্ত বাঙালির না মেটা বাসনাগুলোকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। ‘মাধুকরী’-র নায়ক পৃথু ঘোষ চেয়েছিল ‘বাঘের মতো বাঁচতে’। কে না চায়! পৃথু ফিরতে চেয়েছিল শিকড়ে। কিন্তু সেই ওডেসি কি সত্যিই হয়ে ওঠে? এখানেই বুদ্ধদেবের দর্শন। তাঁর নায়কেরা জানে, তারা বিচ্ছিন্ন। তবু প্রকৃতির কাছে, নারীর কাছে মাধুকরীর ঝুলি নিয়ে তারা দাঁড়ায়। প্রেম থেকে প্রেমে বাঁক নেয় সম্পর্ক। কোথাও থেমে থাকা নেই। অনায়াস ভাবে সে বয়ে যায় নিজের ছন্দে।
তবে বার বার যে একই রাস্তায় হেঁটেছেন বুদ্ধদেব, তা-ও নয়। তাঁর জনপ্রিয়তম উপন্যাসগুলির একটি ‘বাবলি’-তে নায়িকা মোটেই মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো রূপসী নয়। কিন্তু তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার মধ্যবিত্ত বাবলিকে ভাল না বেসে পারেনি বাঙালি পাঠক। এখনওও টিন এজ প্রেমের সূত্রপাত ঘটাতে সমর্থ এই ছোট উপন্যাসটি। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও ভুবনায়ন-পূর্ববর্তী প্রেমের অভিজ্ঞানগুলির সঙ্গে পরিচিত হতে হাতে তুলে নেন এই বই।
এ সবের পাশাপাশি বুদ্ধদেবের কলমে আরও এক জগৎ উদ্ভাসিত। সেটা ‘ঋভু’-র ভুবন। ঋভু সিরিজের উপন্যাস ‘ঋভুর শ্রাবণ’ সম্ভবত প্রকাশিত হয়েছিল কোনও এক শারদীয় ‘আনন্দমেলা’য়। অথচ সেই অর্থে ‘ঋভুর শ্রাবণ’-কে ‘শিশুসাহিত্য’ বলা চলে না। শৈশব থেকে বেরিয়ে আসার আখ্যান ছিল সেটা। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘রুকু সুকু’ সিরিজ যদি একটা সময়পর্বের বাঙালির বয়ঃসন্ধিকে চিনিয়ে থাকে, তবে তার আরেকটি দিক হল ‘ঋভু’। প্রকৃতি, প্রেম, স্মৃতি-বিস্মৃতির চেয়েও খানিক উপচে পড়া মনকেমন করা ছড়িয়ে রয়েছে এই সিরিজে। লেখকের আত্মজীবনী? নাকি যা হয়ে ওঠা যায় না অথচ মাথার মধ্যে বহন করতে হয় সারা জীবন, এই সিরিজ তারই উদাহরণ?
ছবি এঁকেছেন, ছড়া লিখেছেন, গানও গেয়েছেন নিষ্ঠা আর নিবেদনকে একত্র করে। বুদ্ধদেব সেই বিরল প্রজাতির বঙ্গপ্রজন্মের শেষ কয়েকজনের প্রতিনিধি, যাঁরা যা কিছু করেছেন, মন দিয়েই করেছেন। লেখা থেকে গান, গান থেকে ছবি— কোথাও শ্রমবিমুখতার ছাপ পাওয়া যাবে না তাঁর সৃজনে।
এই মুহূর্তে হয়তো বৃষ্টি পড়ছে পলাশতলি অথবা মাসাইমারায়। ঋজুদা আর ঋভুর সঙ্গে এক নৌকায় সওয়ার তাদের স্রষ্টা বুদ্ধদেব। প্রেক্ষিতে তাঁরই গলায় বাজছে নিধুবাবুর গান ‘ভালবাসিবে বলে ভালবাসিনে’। চারপাশ ঝাপসা হয়ে আছে তাঁর আঁকা রহস্যমাখা নিসর্গচিত্রের মতোই। অরণ্য পেরিয়ে হতে চাওয়া জীবনকে সঙ্গে নিয়ে, না হতে পারার বেদনাকে সঙ্গে নিয়ে পাঠকও যাত্রী সেই অভিযানে। আর অভিযান যে কখনও ফুরোয় না, তা বুদ্ধদেবের মতো লেখক জানতেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy