আহত বিজেপি সমর্থক। মঙ্গলবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই স্বীকার করেছেন, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে সিবিআই প্রথম দিনই গ্রেফতার করে নেবে, সেটা তিনি ভাবতে পারেননি। মঙ্গলবার সুদীপবাবু যখন গ্রেফতার হলেন, তার প্রতিবাদে তৃণমূল যেটা করল, সেটা আবার চিন্তার বাইরে ছিল বিজেপি-র! মঙ্গলবার বিকেল থেকে সন্ধে প্রায় তিন ঘণ্টা কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে রইল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের বড় অংশ।
সুদীপবাবু গ্রেফতার হওয়ার পর দু’ ঘণ্টাও কাটেনি। বিকেল পৌনে ৫টা নাগাদ জনা বিশেক তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি) কর্মী জড়ো হন বিজেপি-র রাজ্য দফতরের অদূরে। আচমকাই মুরলীধর সেন লেনে বিজেপি দফতরের দিকে ধেয়ে যান তাঁরা। বিজেপি দফতরের এক তলায় প্রতি দিনই কয়েক জন পুলিশ কর্মী মোতায়েন থাকেন। টিএমসিপি কর্মীদের আটকানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু তাঁদের ধাক্কা দিয়ে প্রায় দফতরের দরজার কাছাকাছি চলে যান টিএমসিপি কর্মীরা। এই পরিস্থিতিতে উত্তেজিত হয়ে জনা তিরিশেক বিজেপি কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে আসেন ভিতর থেকে। তাঁদের তাড়া খেয়ে পালিয়ে যায় টিএমসিপি। সেই সময় বিজেপি সামান্য ইটও ছোড়ে।
এর পরই উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে মহম্মদ আলি পার্কের সামনে থেকে এক দল তৃণমূল কর্মী মিছিল করে বিজেপি দফতরের দিকে আসায়। টিএমসিপি কর্মীরা তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। এই সময় মুরলীধর সেন লেনের ভিতরে ঢুকে প্রায় ১০-১২ মিনিট ব্যাপক ইটবৃষ্টি করেন তৃণমূল কর্মীরা। টিউবলাইট নিয়েও তাঁদের চড়াও হতে দেখা যায়। রাজ্য বিজেপি-র সম্পাদক অমিতাভ রায়, দলের যুব মোর্চার কলকাতা উত্তর পশ্চিম জেলার সহ সভাপতি পঙ্কজ সিংহানিয়া ইটের ঘায়ে আহত হন। সে সময় দফতরেই ছিলেন বিজেপি নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়। তবে তিনি আক্রান্ত হননি। বিজেপি-র অভিযোগ, এ দিনের হামলায় তাদের ১২ জন আহত হয়েছেন। হামলায় জোড়াসাঁকো থানার ওসি অমিত রক্ষিত ও বৌবাজার থানার অতিরিক্ত ওসি সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় আহত হন। পুলিশ ও বিজেপি নেতাদের গাড়িতেও ভাঙচুর হয়।
বিকেল ৫টা নাগাদ পুলিশ বাহিনী এসে মুরলীধর সেন লেনের দুই দিক গার্ড রেল দিয়ে ব্যারিকেড করে দেওয়ার কিছু ক্ষণ পর ইটবৃষ্টি বন্ধ হয়। কিন্তু তার পর সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ওই রাস্তার দু’দিকেই তৃণমূলের জমায়েত এবং বিক্ষোভ চলে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপরে বিজেপি-র ব্যানার ছিঁড়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় তৃণমূল। তাদের অভিযোগ, মমতা যে হেতু নোট বাতিলের প্রতিবাদে আন্দোলন করছেন, তাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি
সিবিআইকে ব্যবহার করে একের পর এক তৃণমূল সাংসদকে গ্রেফতার করাচ্ছে। এরই প্রতিশোধ নিতে নরেন্দ্র মোদীকে ‘চোর’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন তৃণমূল কর্মীরা। তাঁর ইস্তফাও দাবি করা হয়। বিজেপি কর্মীরা মমতার বিরুদ্ধে পাল্টা স্লোগান দেন।
সন্ধ্যা ৭টার পর হিন্দু হস্টেলের দিকে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তৃণমূলের বে কিছু কর্মী ফের বিজেপি দফতরের প্রায় দরজার কাছে চলে যান। তখন আবার বিজেপি কর্মীরা তাঁদের লাঠি দেখান। ৭টা ২০ নাগাদ এন্টালির বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহা, তৃণমূল নেতা জীবন সাহার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে বিক্ষোভস্থলে পৌঁছন। স্বর্ণকমলবাবু বিক্ষুব্ধ কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আপনারা এমন কিছু করবেন না, যাতে দলের বদনাম হয়। শান্তিপূর্ণ ভাবে অবস্থান করুন।’’
গোলমালের সময় ছিলেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ। তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘তৃণমূল পার্টি অফিস ঘিরে রেখেছে বলে আহত কর্মীদের হাসপাতালে পাঠানো যাচ্ছে না। পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করলে তৃণমূল এত অসভ্যতা করার সাহস পেত না।’’ সাড়ে ৭টা নাগাদ এক সেকশন সিআরপিএফ পৌঁছয়। তাদের দেখেই হিন্দু হস্টেলের দিকে থাকা তৃণমূল কর্মীরা পালান। রাহুলবাবুর নিরাপত্তার জন্য তাঁর সঙ্গে দু’জন সিআরপিএফ কর্মী সর্বদাই থাকেন। রাহুলবাবু জানান, গোলমালের সময় তাঁর নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্যই আরও সিআরপিএফ কর্মী পৌঁছন। সওয়া ৮টা নাগাদ তৃণমূলের অবরোধ ওঠে এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বিজেপি-র অভিযোগ, মমতা নিজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেই জন্যই এ দিন বিজেপি দফতরে হামলার সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। লালবাজারের তরফে অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী, বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ, কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) রামলাল, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়কে এ দিনের হামলার ঘটনা জানিয়েছেন রাহুলবাবু। রাতে তাঁকে ফোন করেন রাজনাথ সিংহও। এর পর অমিতের নির্দেশে সহ পর্যবেক্ষক সিদ্ধার্থনাথ সিংহ দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে তৃণমূল নেত্রীকে নিশানা করে বলেন, ‘‘মমতাজি, বিজেপি দফতরে চড়াও হয়ে চিটফান্ড দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়া যাবে না।’’ পরিস্থিতি ভাল করে জানতে এ দিন রাতেই কলকাতায় আসার কথা কৈলাসের।
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ দিন দফতরে ছিলেন না। সন্ধ্যায় তিনি যখন দফতরের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন ডানকুনিতে পুলিশ তাঁকে বলে, এখন তিনি গেলে উত্তেজনা নতুন করে বাড়তে পারে। দিলীপবাবু তার পর গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি চলে যান।
রাজ্য দফতরের পাশাপাশি দক্ষিণ দমদমের প্রমোদনগরে একটি পার্টি অফিসেও হামলা হয়েছে বলে বিজেপি-র অভিযোগ। দলের উত্তর শহরতলির সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ চক্রবর্তীর দাবি, ওই দলীয় কার্যালয়টি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এক কর্মীর মোটরবাইকও ভাঙচুর করা হয়েছে। যদিও দক্ষিণ দমদম পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ প্রদীপ মজুমদারের দাবি, এমন ঘটনার কথা জানা নেই।
রাতে কোচবিহারের বক্সিরহাট ও পুটিমারি ফুলেশ্বরীতেও বিজেপি পার্টি অফিস ভাঙচুরের খবর মিলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy