জহর গঙ্গোপাধ্যায়
গল্প, উপন্যাস বা সিনেমায় এমনটা ঘটতে পারে! বহু বছর আগে চলে যাওয়া মৃতেরাও ফিরে আসতে পারেন এই পৃথিবীতে। ভোটচক্রে পুরাণ, মহাকাব্যের নায়কেরাও কার্যত সশরীরে সমসময়ের মাটিতে নেমে আসার ঘটনা ইদানীং ঘটছে। তা বলে অর্ধ শতক আগে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে যাওয়া তাঁর স্বনামধন্য ঠাকুরদাকে নিয়ে এ ভাবে টানাটানি ঘটবে এত দূর তাঁর নাতনি ভাবতে পারেননি।
বৃহস্পতিবার ভরসন্ধ্যায় তবু তাঁর ঠাকুরদা একদা বাংলা ছবির বিশিষ্ট চরিত্রাভিনেতা জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম ধরে বাড়ির সামনে ডাকাডাকি শোনেন সুজাতা খাস্তগীর। ঠাকুরদা চলে গিয়েছেন তাঁর ছ’বছর বয়সে। এর পরে জীবন গিয়েছে চলে ঝাড়া পাঁচটি দশকের পার। তাই নীচ থেকে হাঁকডাকটি শুনে প্রথমটা থমকে গিয়েছিলেন সুজাতাদেবী। তার পর ফের কান খাড়া করে শোনেন!
‘‘জহরদা বাড়ি আছেন? জহরদা? জহরবাবু কি বাড়িতে নেই?’’
ডোভার লেনের তাঁদের পারিবারিক গৃহেই থাকেন সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ‘আর্ট টিচার’ সুজাতাদেবী। ১৯৬৯-এ প্রয়াত হওয়ার আগে তাঁর পিতামহ ওই বাড়িতেই থাকতেন। সুজাতা হতভম্ব, দাদুর নাম ধরেই তো ডাকাডাকি চলছে। কারা এমনটা করতে পারে? তাঁরা কারা? ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে দেন সুজাতা। আগন্তুকেরা ‘জহরবাবু এখানেই থাকেন তো,’ বলে হেঁ হেঁ ভঙ্গিতে দোতলায় উঠে আসেন।
পরের আলাপচারিতা সংক্ষিপ্ত। কিন্তু সুজাতাদেবীর কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। শুক্রবার বড়দিনের সন্ধ্যায় তিনি যা জানিয়েছেন, তা এই রকম— ‘‘আগন্তুকেরা জনা দুই ছিলেন। এক জন পুরুষ ও মহিলা। সম্ভবত হিন্দিভাষী। হিন্দি টানের বাংলায় তাঁরা বলেন, জহরবাবুকে কিছুতেই ফোনে পাচ্ছেন না। তাই বাড়িতে আসতে হল। সুজাতা এক বার জানতে চান, কোন জহরবাবুকে ওঁরা খুঁজছেন। তত ক্ষণে ‘জহর গাঙ্গুলি’ লেখা বিজেপি পদ্মফুল ছাপ কার্ডটা ওঁরা বাড়িয়ে ধরেছেন। গায়ে ইংরেজিতে লেখা ‘জহর গাঙ্গুলি’। ৬৯ নম্বর ওয়ার্ডে বিজেপির সহ-সভাপতি কৌশল কুমার মিশ্রের নামে লেখা আমন্ত্রণপত্রে অনুরোধ শুক্রবার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর জন্মদিনে রক্তদান শিবিরে ‘জহর গাঙ্গুলি মশাই’কে থাকতেই হবে।
সুজাতাদেবী কথা বাড়াননি। ‘আচ্ছা তাই হবে’ জানিয়ে আগন্তুকদের বিদায় জানান। এ দিন তিনি বলছিলেন, ‘‘তখন থেকেই ভাবছি, বাংলায় ক্ষমতা দখলে কোমর বেঁধে নামা বিজেপি নামক দলটির বাংলা-বাঙালির সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞানগম্যির বহর তা হলে এমনই!’’ তাঁর বক্তব্য, ‘‘আমার দাদুর বিষয়ে ভুল ভাঙানো বা বিষয়টা ওঁদের বুঝিয়ে বলা, সবটাই আমার পণ্ডশ্রম মনে হচ্ছিল।’’
তবে সুজাতাদেবীর ঘনিষ্ঠ মহলে সবটা শুনে বিষয়টা চাউর হয়ে গিয়েছে সমাজমাধ্যমে। প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি ভগিনী নিবেদিতা বা মাদার টেরিজার সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের বাংলায় বহিরাগত তকমা খণ্ডনের চেষ্টা করলেও তা কি আদৌ ঠিক?
রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেন, ‘‘আমাদের কর্মীরা কোনও ভুল করে থাকতে পারেন। তাঁরা হয়তো জানেন না অভিনেতা জহর গঙ্গোপাধ্যায় প্রয়াত। আবার এমনও হতে পারে, অন্য কোনও জহর গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ভেবে তাঁরা অভিনেতার বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। আমরা কর্মীদের এ সব বিষয়ে আরও সতর্ক থাকতে বলব। তবে বিজেপি জহর গঙ্গোপাধ্যায়, জহর রায়দের মতো সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টদের প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল।’’
‘সুলালদা’ নামে পরিচিত জহর গঙ্গোপাধ্যায় বহু বার বিএফজে পুরস্কার পান। সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছাড়াও ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘শহর থেকে দূরে’-র মতো নানা ছবিতে স্মরণীয় তাঁর পর্দায় উপস্থিতি। একদা মোহনবাগানের হকিসচিব জহরবাবু ছেয়ে ছিলেন তৎকালীন বাঙালির সংস্কৃতি-জীবন। তাঁর নাতনির কথায়, ‘‘এত বছর বাদে দাদুর বিষয়ে কিছুই না-জেনে কয়েক জন বিজেপি কর্মী কেন যে দাদুর খোঁজে এলেন। আমিও ভাবছি প্ল্যানচেটে ওঁকে ডেকে জানতে চাইব!’’ বিষয়টা কাকতালীয়, মৃতের মর্ত্যে আগমন ছবিটিতেও জহর গঙ্গোপাধ্যায় অভিনয় করেছিলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy