শুভেন্দু অধিকারী ও দিলীপ ঘোষের মধ্যে ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা জানে বিজেপি। — ফাইল চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর শনিবার প্রথম বৈঠকে বসছে রাজ্য বিজেপির কোর কমিটি। শীর্ষ কমিটির ওই বৈঠকে হাজির থাকার কথা ২৪ জন সদস্যের। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার এখনও দিল্লিতে। তবে শনিবার সন্ধ্যার আগেই তাঁর কলকাতায় ফেরার কথা। সন্ধ্যা ৬টায় বৈঠক শুরু হওয়ার কথা।
সব ঠিক থাকলে সেই বৈঠকে লোকসভা ভোটের পরে প্রথম বার মুখোমুখি হওয়ার কথা বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এবং প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের। ভোটে বিপর্যয়ের পরে রাজ্য বিজেপির একাংশ শুভেন্দুর দিকে আঙুল তুলেছেন। সরাসরি নাম না বললেও শুভেন্দুই যে তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন দিলীপ। অন্য দিকে, তিনি যে কটাক্ষের ‘শিকার’, তা জানিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন শুভেন্দুও। বিরোধী দলনেতা যে অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন, তা অবশ্য বিজেপির কাছে ‘স্বস্তিজনক’ নয়। এই পরিস্থিতিতে শনিবারের বৈঠকে শুভেন্দু-দিলীপ মুখোমুখি হওয়া নিয়ে নানা জল্পনাও তৈরি হয়েছে।
বস্তুত, শেষ পর্যন্ত দুই নেতা বৈঠকে মুখোমুখি হন কি না, তা নিয়েও জল্পনা রয়েছে। আমন্ত্রিত দু’জনই। দিলীপ সাধারণত কোর কমিটির সব বৈঠকেই হাজির থাকেন। তবে এমন বৈঠকে শুভেন্দুর গরহাজির থাকার নজির রয়েছে। রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য মনে করছেন, দু’জনে হাজির থাকলেও ‘অস্বস্তিকর’ কিছু হবে না। কারণ, দু’জনেই অভিজ্ঞ রাজনীতিক। দ্বিতীয়ত, অতীতে দুই নেতার মধ্যে মতানৈক্য হলেও প্রকাশ্যে সৌজন্য বজায় রেখেছেন দু’জনেই।
মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে তাঁকে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে পাঠানোর পরেও দিলীপ ভেবেছিলেন জিতে যাবেন। তখন দল বা দলের কোনও নেতাকেই আক্রমণ করেননি ‘অনুগত’ দিলীপ। কিন্তু শুধু পরাজয় নয়, ‘গোহারা’ হারতে হয়েছে তাঁকে। ২০১৯ সালে অল্প ভোটে বিজেপির জেতা আসনে এ বার দিলীপ হেরেছেন ১ লাখ ৩৭ হাজারেরও বেশি ভোটে। তার পরেই তিনি সরব হয়েছেন। দিলীপের আসনবদল শুভেন্দুর কথাতেই হয়েছিল বলে বিজেপিতেই আলোচনা রয়েছে। সেই আলোচনা বলছে, ‘পছন্দের প্রার্থী’ অগ্নিমিত্রা পালকে মেদিনীপুরে টিকিট দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন শুভেন্দুই। সে কারণেই দিলীপের আসনবদল। ঘটনাচক্রে, দু’টি জেতা আসনেই হেরেছে বিজেপি। তার পরেই দিলীপ প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘‘আমাকে যে কাঠি করে মেদিনীপুর থেকে সরানো হয়েছে, সেটা তো সকলেই জানে!’’ তাঁর বিরুদ্ধে ‘চক্রান্ত’ হয়েছিল বলেও দাবি করেন তিনি। সরাসরি কারও নাম নেননি দিলীপ। কিন্তু বলেছিলেন, ‘‘আমি হারিনি। বিজেপি হেরেছে। আমাকে হারাতে গিয়ে মেদিনীপুর আসনটাও হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে।’’
ভোটে বিপর্যয়ের পর অন্যান্য দলে যা হয়ে থাকে, বিজেপিতেও এখন তা-ই হচ্ছে। সকলেই অপর পক্ষকে কাঠগড়ায় তুলছেন। অনেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও দায়ী করছেন। কারণ, তাঁরা শুভেন্দুর কথার উপরে বেশি ‘ভরসা’ করেছিলেন। বিষ্ণুপুর আসনে জয়ী সৌমিত্র খাঁ রাজ্য স্তরে অভিজ্ঞ নেতার অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তৃণমূলের সঙ্গে কারও কারও বোঝাপড়া হয়ে থাকতে পারে বলেও বলেছেন। নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাঁকুড়ার বিধায়ক নীলাদ্রিশেখর দানা।
এ সবের মধ্যেই শুভেন্দু বলেছেন, “দলের ভিতরের কোনও কথা প্রকাশ্যে আমি বলি না। আমি খুব ডিসিপ্লিন্ড। তাতে সকলে আমায় পুরস্কার দেয় না। কেউ কেউ তিরস্কারও দিতে পারে। অনেকে অনেক কিছু পোস্টও করতে পারে। তির্যক মন্তব্য করতে পারে।” তাঁর এই মন্তব্য মূলত দিলীপের উদ্দেশে বলেই মনে করছে রাজ্য বিজেপির অন্দরমহল। কারণ, ‘কাঠিবাজি’ মন্তব্যের পরে দিলীপ গত শনিবার এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, “ওল্ড ইজ় গোল্ড’’। যার বাংলা তর্জমা করলে হয়— ‘পুরনো জিনিস সোনার মতো দামি’। এটা যে বিজেপির আদি নেতা তথা কর্মীদের গুরুত্ব আদায়ের জন্যই বলেছেন, তা স্পষ্ট।
এমন পরিবেশের মধ্যেই বৈঠকে বসছে রাজ্য বিজেপি। পদ্মশিবির সূত্রে জানা গিয়েছে, বৈঠকে লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। একই সঙ্গে আসন্ন উপনির্বাচন নিয়েও কথা হবে। যে চারটি বিধানসভা আসনে ভোট হবে, তার মধ্যে তিনটি রায়গঞ্জ, রানাঘাট দক্ষিণ এবং বাগদায় ২০২১ সালে জিতেছিল বিজেপি। লোকসভা নির্বাচনে মানিকতলা আসনে খুব অল্প ভোটে পিছিয়ে তারা। ফলে এই উপনির্বাচন বিজেপির কাছে ‘গুরুত্বপূর্ণ’। প্রার্থী নিয়ে আলোচনাও হতে পারে শনিবার। তবে সেই আলোচনায় শুভেন্দু থাকবেন কি না, তা দেখার কারণ, তিনি আগাম বলে রেখেছেন, ‘‘প্রার্থী নির্বাচন, প্রচারকৌশল সবটাই সংগঠন তৈরি করে। এ সব বিষয়ে জেলা সভাপতিরা বলতে পারবেন।’’ সেখানেই না থেমে শুভেন্দু বলেছেন, ‘‘সংগঠনের বিষয়ে আমি কোনও প্রতিনিধিত্ব করি না। আমার কাজ প্রচার করা। সাংগঠনিক ব্যাপারে আমি হস্তক্ষেপ করি না। ভবিষ্যতে করার ইচ্ছেও নেই।’’
শুভেন্দু এমন দাবি করলেও দলের নেতারা অবশ্য তা মনে করেন না। পদ্মশিবিরের বক্তব্য, লোকসভা ভোটে অনেক ক্ষেত্রেই সাংগঠনিক বিষয়ে মতামত দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা। বিজেপি এ বার আরও দুই বিদায়ী সাংসদের কেন্দ্র বদল করেছিল। সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াকে বর্ধমান-দুর্গাপুর থেকে সরিয়ে আসানসোলে এবং রায়গঞ্জ থেকে কলকাতা দক্ষিণে দেবশ্রী চৌধুরীকে প্রার্থী করা হয়েছিল। ওই সব পরিবর্তনে শুভেন্দুর মতামত ‘গুরুত্ব’ পেয়েছিল বলেই জানিয়েছিলেন রাজ্যনেতারা। জেতার মতো পরিস্থিতিতে থাকা ঘাটাল, আরামবাগ, কলকাতা উত্তর, ব্যারাকপুর আসনেও শুভেন্দুর ‘পছন্দ’ মেনে নেওয়া হয়েছিল।
প্রার্থী বাছাইয়ে ‘স্বাধীনতা’ পাওয়া শুভেন্দু ভোটের প্রচারে ব্যাপক পরিশ্রমও করেছেন। ভোট ঘোষণার পরে দেড়শোর কাছাকাছি সভা, রোড-শো করেছেন। কিন্তু বিজেপির ফলাফলে অন্যদের মতো ধাক্কা খেয়েছেন শুভেন্দুও। তা সত্ত্বেও তাঁর সমালোচনা বেশি হওয়ায় তিনি যে ক্ষুব্ধ, তা বুঝিয়ে শুভেন্দু বলেছেন, “ভাল হলে নিজেদের ক্রেডিট দেন। খারাপ হলে আমার ঘাড়ে চাপান। আমি কখনওই দলের অভ্যন্তরের বিষয় বাইরে বলি না।”
শনিবার কোর কমিটির বৈঠকেও কি শুভেন্দু সরব হবেন? দিলীপও কি মনের ক্ষোভ উগরে দেবেন? বৈঠকে থাকার কথা রাজ্য বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা সুনীল বনসল, মঙ্গল পাণ্ডে, অমিত মালব্য এবং আশা লাকড়ারও। সেখানে শুভেন্দু-দিলীপের কি ‘সম্মুখসমর’ হবে? না কি ‘সম্মুখ-সমঝোতা’?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy