শুভেন্দুতেই ভরসা প্রলয়ের। —ফাইল ছবি।
প্রলয় পাল বিজেপি ছাড়ছেন না। রাজনীতিও ছাড়ছেন না। রবিবার সকালেই এই ঘোষণা করে নন্দীগ্রামের নেতা স্বস্তি দিয়েছেন বিজেপিকে। তবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় পদ্মের ‘প্রলয়’ রোখা যায়নি বলেই দাবি করছেন জেলার নেতারা। নিজের জেলা তথা বিধানসভা এলাকা নন্দীগ্রামে ‘প্রলয়’ রুখতে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বড় ভূমিকা রয়েছে বলেই অনেকের দাবি। কারণ, একাংশের অভিযোগ ছিল, মূলত শুভেন্দুর মদতেই তাঁর ঘনিষ্ঠেরা জেলায় রাজ করছেন। আর তা নিয়েই আপত্তি ছিল প্রলয়ের। তবে সেটা মানতে রাজি নন প্রলয়। তাঁর দাবি, সব বিষয় শুভেন্দু জানেনও না। বরং, তাঁর নাম ভাঙানো হচ্ছে। প্রলয় আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘শুভেন্দু অধিকারী এই জেলার মানুষ, এখানকার বিধায়ক হতে পারেন কিন্তু তিনি বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। ছোটখাট বিষয়ে তিনি থাকেন না। থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু তাঁর নাম ভাঙিয়ে অনেকে অনেক কিছু করছেন।’’ যদিও এই ‘অনেক’ কারা, তা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি প্রলয়।
প্রশাসনিক পূর্ব মেদিনীপুর জেলা বিজেপির সাংগঠনিক ভাগে দু’টি জেলা। দুই লোকসভা এলাকা কাঁথি ও তমলুক হিসাবে ভাগ। দু’টি আসন এলাকাতেই গত বিধানসভা নির্বাচনে দক্ষিণবঙ্গের অন্য এলাকার তুলনায় ভাল ফল করেছিল বিজেপি। আগামী লোকসভা নির্বাচনে অধিকারী পরিবারের হাতে থাকা দু’টি আসনেই জয়ের স্বপ্ন দেখছে গেরুয়া শিবির। এই দুই কেন্দ্র রয়েছে রাজ্য বিজেপির অন্যতম মুখ বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর পিতা শিশির অধিকারী ও ভাই দিব্যেন্দু অধিকারীর হাতে। শিশির ও দিব্যেন্দু খাতায় কলমে তৃণমূল সাংসদ হলেও তাঁদের সঙ্গে দলের ‘দূরত্ব’ ততটাই যতটা ‘ঘনিষ্ঠতা’ শুভেন্দুর দল বিজেপির সঙ্গে।
এই দুই জেলায় বিজেপি জেরবার অন্দরের ‘আদি’ বনাম ‘নব্য’ বিবাদে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে আগে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন শুভেন্দু। সেই সময়েই ২০২০ সালের ১৯ ডিসেম্বর শুভেন্দুর সঙ্গে বিজেপিতে আসেন তখন সিপিএম বিধায়ক তাপসী মণ্ডল। এখন বিজেপির টিকিটেই তাঁর পুরনো আসন হলদিয়া থেকে বিধায়ক হন তিনি। এখন তাঁকেই হলদিয়ার জেলা সভাপতি করেছে রাজ্য বিজেপি। আর তাঁর তৈরি জেলা কমিটি নিয়েই যত ক্ষোভ। বিজেপি সূত্রে জানা যায়, সেই ক্ষোভ থেকেই রাজনীতি ছাড়তে চেয়েছিলেন প্রলয়। তা আপাতত রুখে দিতে পেরেছে জেলার গেরুয়া শিবির। তবে এখন সিঁদুরে মেঘ রয়েছে। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রলয়কে ধরে রাখতে শনিবারই একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়। সেখানেই ‘মানভঞ্জন’ করা গিয়েছে।
শুধু তমলুক সাংগঠনিক জেলাতেই নয়, বিজেপি ‘আদি’ বনাম ‘নব্য’ বিবাদ রয়েছে কাঁথি জেলাতেও। সম্প্রতি এই জেলার সভাপতি করা হয়েছে কাঁথি দক্ষিণের বিধায়ক অরূপকুমার দাসকে। প্রাক্তন শিক্ষক অরূপকুমারও শুভেন্দুর হাত ধরেই বিধানসভা নির্বাচনের মুখে মুখে বিজেপিতে আসেন এবং প্রার্থী হন। সদ্য তাঁদের জেলা সভাপতি করেছেন রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার।
গত শুক্রবার প্রলয় যখন শুধু বিজেপি নয়, রাজনীতিই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন তখন দলের অন্দরেই এমনটা শোনা গিয়েছিল যে, তমলুক জেলার নতুন সভাপতি তথা হলদিয়ার বিধায়ক তাপসী মণ্ডলের বিরুদ্ধেই যত ক্ষোভ। ফেসবুকে প্রলয় লিখেছিলেন, ‘‘ভাল থেকো রাজনীতি। আর নয়। দাও বিদায়।’’ পরে সংবাদমাধ্যমে কথা বললেও তিনি একটি বারের জন্যও তাপসীর নাম বলেননি। একই ভাবে চুপ তাপসী। শুক্রবারের মতো রবিবারও তাপসীর সঙ্গে আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই বিষয়ে কথা বলতে চাননি। প্রলয়ের মানভঞ্জন কি শুভেন্দুর মধ্যস্থতায়? প্রশ্ন শুনে তাপসী শুধু বলেন, ‘‘কোনও গোলমাল নেই।’’
তবে জেলার নেতারা বলছেন, শুধু প্রলয় নয়, অনেকেই ক্ষুব্ধ। প্রলয় ইস্তফা দিলে সেটা বড় আকার নিতে পারত। এর পরেই উদ্যোগ শুরু হয়। শনিবার রাতে জেলার নেতারা প্রলয়ের সঙ্গে বসেন, সেখানে কথা বলেই আপাতত বিষয়টি ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়। সকলের অনুরোধে প্রলয় সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর সিদ্ধান্ত বদলের কথা নেতাদের নির্দেশেই বলেন। তবে এর পরেও ক্ষোভ রয়ে গিয়েছে বলেই মনে করছেন জেলার নেতারা। পূর্ব মেদিনীপুরের বাসিন্দা এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘অনেক কিছু নিয়েই ক্ষোভ রয়েছে। সব চেয়ে বেশি পুরনোদের গুরুত্ব না দেওয়া নিয়ে। প্রলয় রাজনীতি ছাড়ার কথা এমনি বলেনি। ওঁর সঙ্গে অনেকেই রয়েছেন। সমস্যা মেটাতে হলে নতুনদের পাশাপাশি পুরনোদের গুরুত্ব দিতে হবে। ধামাচাপা না দিয়ে পুরোপুরি সমাধান দরকার।’’
শুক্রবার জেলা কমিটির তালিকা প্রকাশের পরে দলের জেলা নেতাদের হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ থেকেও বেরিয়ে যান প্রলয়। শনিবার ইস্তফপত্র জমা দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু জেলা সভাপতি না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এর পরে বলেছিলেন, ‘‘জেলা সভাপতি ফিরলেই আমি তাঁর কাছে ইস্তফাপত্র জমা দেব। আর আমাকে সহ সভাপতির পদে বসানোর জন্য ওঁকে ফুল, মিষ্টিও দেব।’’ তবে রবিবার প্রলয় বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁর মানভঞ্জন হয়ে গিয়েছে। আর রাজনীতি ছাড়তে চান না। তিনি ইস্তফা দিলে কি দলে আরও ভাঙন দেখা দিত? প্রশ্নের জবাবে প্রলয় বলেন, ‘‘সেটা জানি না। তবে দলের অনেক কর্মীর ত্যাগ আর ভালবাসার কথা ভেবেই সিদ্ধান্ত বদলেছি।’’
অতীতে নন্দীগ্রাম ২ ব্লকের সভাপতি প্রলয়কে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করার পরে তা নিয়ে শোরগোল তৈরি হয়েছিল রাজ্য রাজনীতিতে। বিজেপির অভিযোগ ছিল নন্দীগ্রামের প্রার্থী মমতা ভোটে সাহায্য চেয়েই ফোন করেছিলেন। পরে ফোন করার কথা নিজেই জানান মমতা। নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়েই তিনি বলেছিলেন, ‘‘মনে রাখবেন, প্রার্থী হিসেবে আমি কারও কাছে আর্জি জানাতেই পারি যে আপনার ভোটটা আপনাকে দেবেন। যখন নরেন্দ্র মোদী তৃণমূলের লোকেদের ফোন করেন, তখন দোষ হয় না? উনি তো পঞ্চাশটা করে ফোন করেন! আমি যদি নন্দীগ্রামের এক জন ভোটারের অনুরোধে তাঁকে ফোন করি, অন্যায়টা কোথায়? এ রকম ফোন আমি অনেক করব। আমি জনগণের সেবা করি। কেউ কিছু জানতে চাইলে, তাকে জানানো আমার কর্তব্য। সে যদি কথা রেকর্ড করে, ভাইরাল করে, তার শাস্তি হওয়া উচিত। আমার নয়। কথা রেকর্ড করে ভাইরাল করা অপরাধ। এটা প্রতারণা। করা যায় না।’’
বিধানসভা নির্বাচন পর্বে তো বটেই সদ্যসমাপ্ত পঞ্চায়েত ভোটের সময়েও শুভেন্দুর পাশে ছিলেন প্রলয়। এখন তিনি বলছেন, ‘‘আগে যাঁদের কখনও কোনও গুরুত্বপূর্ণ লড়াই-আন্দোলনে দেখা যায়নি তাঁদের এখন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। আর যাঁরা আজীবন লড়াই করেছেন তাঁদের গুরুত্বই থাকছে না।’’ শুধু তাই নয়, ‘‘বিজেপিতে পরিবারতন্ত্র চলছে’’ বলেও অভিযোগ করেন তিনি। তাঁর কথার সুর ধরেই অনেক বলছিলেন, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বিজেপির শক্তি বাড়তে থাকে। কিন্তু দলে গুরুত্ব পাচ্ছেন যাঁরা ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে আগে বিজেপিতে এসেছেন। এই সূত্রেই প্রশ্ন উঠছিল, তবে কি প্রলয় এবং তাঁর ঘনিষ্ঠদের ক্ষোভ অধিকারী পরিবারের দিকে? যদিও প্রলয়ের স্পষ্ট কথা, ‘‘এই দ্বন্দ্বে অধিকারী পরিবারের কোনও যোগ নেই। তবে ওই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে বলে কেউ কেউ নাম ভাঙিয়ে অধিকার ফলাতে চাইছেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy