উদয়নকে দেখতে ভিড়। মঙ্গলবার বাঁকুড়া আদালত চত্বরে। নিজস্ব চিত্র
চিড়িয়াখানায় যেন নতুন অতিথি এসেছে! যে সে নয়, ভিআইপি।
লোকও তাই হামলে পড়েছে। তাকে দেখতে সে কী ভিড়! সে কী হুড়োহুড়ি, দৌড়োদৌড়ি! সবাই এক ঝলক দর্শন চান তার। কেউ চান, গালিগালাজ করে মনের ঝাল মেটাতে। কেউ স্রেফ কৌতূহলী। কিছু অত্যুৎসাহী কয়েক জনের আবার খুব ইচ্ছা, একটা ‘সেলফি’ হয়ে যাক। সে ইচ্ছাপূরণ অবশ্য তাঁদের হয়নি।
চুম্বকে এ রকম টুকরো-টুকরো দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইল মঙ্গলবারের বাঁকুড়া আদালত চত্বর। যাকে ঘিরে এত কাণ্ড, সেই উদয়ন দাস কিন্তু আগাগোড়া ভাবলেশহীন। দেখে কে বলবে, শ্যামলা রঙের এই যুবকই তিন-তিনটে খুনে অভিযুক্ত! প্রেমিকা আকাঙ্ক্ষা শর্মা তো বটেই, সম্পত্তি হাতাতে নিজের বাবা-মাকেও মেরে পুঁতে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে যে যুবকের বিরুদ্ধে।
বাঁকুড়ার মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) অরুণকুমার নন্দীর এজলাসে এ দিন উদয়নকে পেশ করে পুলিশ। সরকার পক্ষের আইনজীবী অমিত দত্ত তার সম্পর্কে মন্তব্য করেন— ‘‘ঠান্ডা মাথার খুনি!’’
কিন্তু, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সাদা ট্রাউজার, সাদা টি-শার্ট পরা সেই ছেলেকে দেখে মনেই হচ্ছিল না, সে সব তার কানে ঢুকছে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে মাঝেমধ্যেই ঘন নীল ব্লেজার ঠিক করছিল। থিকথিক ভিড়ের কোর্টরুমে নজর ঘুরিয়ে মাঝেমধ্যেই আঙুল চালিয়ে ঠিক করছিল চুল। মুখের বিরক্তি ভাব। ভাবখানা এমন, ‘আর কতক্ষণ কাঠগড়ায় থাকতে হবে?’
ভোপালের সাকেতনগরের যুবক উদয়নকে দেখলে মঙ্গলবার বোঝার উপায় নেই, এজলাসে ঢোকার আগে তাকে বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে। পুলিশ ও কমব্যাট ফোর্সের ঘেরাটোপে এজলাসে ওঠার সময় হাজার খানেকের ভিড় থেকে ভেসে আসে ‘ধর ব্যাটাকে, মার ব্যাটাকে’। সকালে থানা থেকে কোর্টের পুলিশ লক-আপে তোলার পরে গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি কড়া শাস্তির দাবিতে কিছুক্ষণ বিক্ষোভও দেখায়। কিন্তু যাকে নিয়ে এত কিছু, তাকে যেন সে সব স্পর্শ করেনি। ভিড়ে এজলাসের দরজাও বন্ধ করে দেয় পুলিশ।
সোমবার রাত ১১টা নাগাদ বাঁকুড়া সদর থানায় উদয়নকে ঢোকানোর সময় থেকেই পুলিশকে তার নিরাপত্তা নিয়ে চূড়ান্ত সতর্ক দেখা যায়। উদয়নের উপর যাতে বাইরে থেকে কেউ নজরদারি না চালাতে পারে সে জন্য, লক-আপের লোহার দরজার বাইরে সবুজ প্লাস্টিক ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এক পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘উদয়নের সঙ্গে কোনও জামা-কাপড় ছিল না। রাতে থানা থেকেই তাকে টি-শার্ট ও প্যান্ট কিনে দেওয়া হয়। ডিমের ঝোল, সয়াবিনের তরকারি ও ডাল দিয়ে ভাত খায়।’’ পুলিশকর্মীদের সঙ্গে গল্প করেছে সে। খাবার নিয়ে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না জানিয়ে তাঁদের ধন্যবাদও দিয়েছে।
এ দিন সকালে স্নানের আগে চপ-মুড়িও দিব্যি খেয়েছে উদয়ন। নিরাপত্তার কারণে ঝুঁকি এড়াতে বাঁকুড়া মেডিক্যাল থেকে ডাক্তার এনে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। পুলিশের আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা এ দিন আদালত চত্বরে জড়ো হওয়া ভিড় এবং উদয়নের প্রতি উগরে দেওয়া ক্ষোভেই স্পষ্ট। ওই আশঙ্কাতেই এ দিন কোর্ট লকআপে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে না রেখে উদয়নকে বসিয়ে রাখা হয় কোর্ট ইনস্পেক্টরের অফিসে। আইনজীবী, মুহুরি থেকে পুলিশকর্মী— যে যেমন সুযোগ পেয়েছেন, উদয়নকে দেখতে ঢুঁ মেরেছেন সেই ঘরে। জনা দুই মহিলাকে দরজায় দাঁড়িয়ে উদয়নকে নিয়ে নিজস্বী তুলতেও দেখা গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকর্মীরা রে রে করে তেড়ে গিয়েছেন। উদয়নকে আট দিন পুলিশ হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
আকাঙ্ক্ষার পরিবার অবশ্য আদালতে আসেনি। তাঁর বাবা শিবেন্দ্র শর্মার কথায়, ‘‘ওকে দেখার আমাদের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তবে, পুলিশ তদন্তে ওর সামনে যেতে বললে, যাব।’’ জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, কতগুলি ধোঁয়াশা স্পষ্ট করতে আকাঙ্ক্ষার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে উদয়নকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করা হবে। জেলা পুলিশ সুপার সুখেন্দু হিরা এ দিন বিকেলে নিজের অফিসে উদয়নকে নিয়ে এসে জেরা করেন। তিনি বলেন, ‘‘আকাঙ্ক্ষা খুনের সঠিক মোটিভ জানতে সব রকম চেষ্টা করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy