সেরা বাঙালি, ‘কালকের সেরা আজকের’ বিজয়ীরা। বাঁ দিক থেকে পীতাম্বর খান, দেবাদিত্য প্রামাণিক, অয়নিকা পাল, ঋদ্ধি সেন, রিতিকা নাথ, লগ্নজিতা চক্রবর্তী। সঙ্গে সঞ্চালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার জি ডি বিড়লা সভাঘরে। —নিজস্ব চিত্র।
এগারো ক্লাসের ঝকঝকে ছেলেটিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাঁর প্রিয় ফুটবল ক্লাব কোনটা?
দুই কিংবা তিন দশক আগেও তাঁর সমবয়সি বঙ্গসন্তানেরা যে উত্তর দিতেন, দেবাদিত্য প্রামাণিক তার ধারে-কাছে হাঁটেননি। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ভক্তটি মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের নাম মুখেও আনলেন না। কিন্তু উৎসুক স্বরে শোনালেন, গড পার্টিক্ল বা ঈশ্বরকণা নিয়ে গবেষণার টিমে কাজ করতে পারলে ধন্য হবেন তিনি।
কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই আন্তর্জাতিক জুনিয়র বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে পরপর দু’টি সোনার পদক এবং জ্যোতির্বিদ্যা ও জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডের সোনার পদক জমা হয়েছে ছেলের ঝুলিতে। দেখে বোঝা যাবে না, মৃদুভাষী, সৌম্যদর্শন বাঙালি ছেলে ক্যারাটেরও ব্ল্যাক বেল্ট! বিজ্ঞানচর্চায় বাঙালির হবু রোল-মডেল বা ভবিষ্যতের ‘সেরা বাঙালি’ হিসেবে বৃহস্পতি-সন্ধ্যায় এই দেবাদিত্যর সঙ্গেও আলাপ হল কলকাতার।
তিনি অবশ্য একা নন! ২০১৬-র ব্রাজিল অলিম্পিকে এয়ার রাইফেল শ্যুটিংয়ে দেশের আশা অয়নিকা পাল, অভিনয়ের ক্ষেত্রে সদ্য ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’-খ্যাত ঋদ্ধি সেন, হিট গান ‘বসন্ত এসে গেছে’র অন্য রকম কণ্ঠ লগ্নজিতা চক্রবর্তী, চিত্রশিল্পী পীতাম্বর খান বা গল্পকার রিতিকা নাথরাও তাঁর সঙ্গে এক বন্ধনীতে ধরা পড়লেন।
এবিপি আনন্দ-র বচ্ছরকার পার্বণ ‘সেরা বাঙালি’-র বোধনের আগে এক অন্য মাত্রা যোগ হল এ বার। বাঙালির সেরার স্বীকৃতির দশক পেরোনো উৎসব এ বার আলো ফেলছে আগামীর সেরাদের দিকে। জিডি বিড়লা সভাঘরের আসরে সেটাই দেখা গেল। ‘কালকের সেরা আজকে’ শীর্ষক পুরস্কারের আসর যেন জহুরির চোখে এই ভবিষ্যতের রত্নদের নিয়েই মেতে থাকল।
ছকভাঙা বাঙালিয়ানার বিচিত্র রং উপচে পড়ল সন্ধের ক্যানভাসে। মিউনিখে রাইফেল শ্যুটিংয়ের আন্তর্জাতিক আসরের সোনার মেয়ে তথা এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জজয়ী, মুম্বইবাসী অয়নিকা ইঞ্জিনিয়ারও বটে। এম-টেক দ্বিতীয় বর্ষের পডুয়া শোনালেন ‘টাইম-ম্যানেজমেন্ট’ বা সময়ের সদ্ব্যবহারের মহিমা। খেলা বা পড়া— কোনওটাকেই অবহেলা করেননি অয়নিকা। শ্যুটিং ইভেন্টে যোগ দিতে যাওয়ার পথে বিমানে পরীক্ষার পড়া ঝালিয়ে নিয়েছেন। ঘরে ফিরে পরের দিন নির্ভাবনায় পরীক্ষা দিতেও গিয়েছেন অয়নিকা।
সারা ক্ষণ চোখেমুখে কথা বলছিলেন ভবিষ্যতের ‘সেরা বাঙালি’দের কেউ কেউ! বায়োটেকনোলজির এমএসসি, কণ্ঠশিল্পী লগ্নজিতা কথার টক্করেও সঞ্চালকদের সঙ্গে পাল্লা দিলেন। কলকাতার একটি বিশিষ্ট নাট্যশিল্পী পরিবারের ছেলে, কৌশিক সেনের পুত্র ঋদ্ধি ইতিমধ্যেই যে কোনও বিষয়ে গম্ভীর ভাবে সুচিন্তিত মতামত দিতে দুরস্ত। তাই কোনও কোনও বড়র কাছে ‘পাকা ছেলে’ উপাধি পেয়েছেন। সদ্য স্কুল-পাশ ঋদ্ধি এখনই সার বুঝেছেন, অভিনয়টা স্রেফ আবেগ দিয়ে হয় না। মঞ্চে ম্যাকবেথের ডাইনি থেকে সেলুলয়েডে পাড়ার হার না-মানা ফুটবলযোদ্ধার ভূমিকায় স্বচ্ছন্দ নবীন বাঙালি সোজাসাপ্টা ভাবে বিজ্ঞানসম্মত অভিনয়-শিক্ষার হয়ে সওয়াল করলেন।
কেউ কেউ আবার খানিক মুখচোরা! কিন্তু নিজের লক্ষ্যটা এখনই চিনে নিয়েছেন। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি অনার্স পড়ছেন রিতিকা নাথ। মোটে ১৯ বছর বয়সেই বুঝে নিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যের উঠোনই তাঁর খেলার মাঠ। আনন্দমেলা-য় পরপর গল্পে বাহবা কুড়োনোর পরে এখন নিজের নতুন থ্রিলারে পাখির চোখ দেখছেন।
হাওড়ার সমুদ্রগড় থেকে উঠে আসা চিত্রশিল্পী পীতাম্বর খানের উড়ান তো সত্যিই রূপকথা। পড়তে ভাল লাগলেও পরীক্ষা পছন্দ নয় বলে চিত্রশিল্পী হওয়ার ঝোঁকেই ক্লাস ইলেভেনে এক বার বাড়ি থেকে পালিয়েছিলেন। আর্ট কলেজে-টলেজে ঢুকতে গেলে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করতেই হবে জানার পরে বাড়ি ফিরে যান। সিমা আর্ট গ্যালারি-র বিশেষ জুরি পুরস্কারজয়ী পীতাম্বর এখন গুড়গাঁওবাসী। এ দেশের হাইওয়েতে ঝোড়ো গতিতে এগোনো ট্রাকের দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে তাঁর কল্পনার ঘোড়া। ‘‘রাজ্যে রাজ্যে ট্রাকের গায়ে নকশার রকমফের, তাতে ধর্মবিশ্বাস বা জীবন ভাবনার ছাপ খোলা বইয়ের মতো আমায় শিক্ষা দেয়। এই আঙ্গিকটাতেই মেতে আছি।’’— থেমে থেমে বললেন পীতাম্বর।
দিব্যেন্দু বডুয়া, সহেলি বডুয়া, জয়দীপ কর্মকার, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, রুদ্রনীল ঘোষ, সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, লক্ষ্মীরতন শুক্ল, রণদেব বসুর মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বাঙালিরা পুরস্কার তুলে দিলেন এই ‘কালকের সেরা’দের হাতে। সঞ্চালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের আশা, ‘‘দুনিয়া এক দিন এই বাঙালিদের নির্ঘাত মাথায় করে নেবে।’’
আর হ্যাঁ, আজ, শুক্রবার এবিপি আনন্দ-র ‘সেরা বাঙালি’-র মঞ্চেও পুরস্কারজয়ীদের সঙ্গে দেখা যাবে আগামীর এই স্ফুলিঙ্গদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy