সে বার ও এ বার: সেরা বাঙালির মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য, ২০১১ ও ২০১৫-র সেরার সেরা। শুক্রবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।
এক জন সামলাচ্ছেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কোটি কোটি মানুষের আমানত। আর এক জন চালাচ্ছেন রাজ্যপাট।
সেরা বাঙালির মঞ্চে দেখা হল দু’জনের। সাদা খোলের ডোরাকাটা শাড়ি-হাওয়াই চপ্পল রোজ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। শুক্রবার তিনি নিজেই ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্যর কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জিজ্ঞাস্য, ‘‘মেয়েরা অর্থমন্ত্রী হলে কি আরও বেশি কালো টাকা উদ্ধার করতে পারবে?’’ অরুন্ধতীর সহাস্য উত্তর, ‘‘মেয়েরা আরও ভাল চালাবে!’’
অন্য দিন হলে হয়তো রাজনীতির রিপোর্টাররা মমতার প্রশ্নের পিছনে অরুণ জেটলির প্রতি তির ছোড়ার চুলচেরা হিসেব কষতে বসতেন। কিন্তু সেরাদের অনুষ্ঠানে রাজনীতির রং থাকে না। এবিপি আনন্দের সেরা বাঙালি ২০১৫-র অনুষ্ঠানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, ‘সেরার সেরা’ পরিবারের অংশ। এ বছরের সেরার সেরা-র হাতে পদক তুলে দেবেন তিনি, ২০১১ সালের সেরার সেরা! সঞ্চালক যখন তাঁকে ডাকছেন, কিঞ্চিৎ বিস্মিত ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন মমতা। সম্ভবত বোঝাতে চাইলেন, ‘না না আমি কেন?’ তার পরই অবশ্য উঠে এলেন মঞ্চে। খোলা মনে বললেন, ‘‘অনেক দিন পর আপনাদের সঙ্গে দেখা হল! ভাল লাগছে!’’ হাততালিতে ফেটে পড়ল প্রেক্ষাগৃহ। দর্শকাসনের এক দিকে তখন রাহুল সিংহ, শমীক ভট্টাচার্য আর সুজন চক্রবর্তী প্রায় পাশাপাশি!
মুখে আগাগোড়া হাসি লেগে ছিল অরুন্ধতীরও। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ইতিহাসে তিনিই প্রথম মহিলা চেয়ারপার্সন। সংসার আর চাকরি, দুইই সামলাচ্ছেন দশ হাতে। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে ধন্যবাদ জানালেন তাঁর কাজের সঙ্গে জড়িত সকলকেই। পরিবারের সহযোগিতার কথা যখন বললেন, বাদ গেল না পরিচারিকার নামও।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই আনন্দবাজার সংস্থার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার তাঁর বক্তৃতায় বলছিলেন, ‘‘গত চল্লিশ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় আমরা সুজলা সুফলা বঙ্গভূমিকে প্রায় মরুভূমিতে পরিণত করেছি। এটাও হয়তো এক ধরনের সেরা বাঙালির খেতাব দাবি করে। তাই বাঙালির মন জয় না করে পৃথিবীর মন জয় করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।’’ মুখ্যমন্ত্রীর মুখেও শোনা গেল, ‘‘আমি তো বিশ্ব বাংলার কথাই বলি।’’ জন্মভূমির টানকে ভুলে না গিয়েও এ দিনের সেরারা কিন্তু প্রায় সকলেই বিশ্বজয়ের পথেই পা বাড়িয়েছেন। শুক্রবারের আইটিসি সোনার-এর মঞ্চ এমন ন’জন কৃতী বাঙালিকেই এক সুতোয় গাঁথল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির প্রাক্তন ছাত্রী অরুন্ধতী ‘ফরচুন’ পত্রিকার তালিকায় দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মহিলাদের মধ্যে তিরিশ নম্বরে। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল, হিলারি ক্লিন্টন, মিশেল ওবামার সঙ্গে এক সারিতে তিনি। গল্ফ-এ সম্প্রতি তাক লাগানো সাফল্য পাওয়া অনির্বাণ লাহিড়ী বিশ্বের সেরা পাঁচে জায়গা করে নিয়েছেন। ক’দিন আগেই মধুচন্দ্রিমা অসমাপ্ত রেখে ছুটে গিয়েছিলেন উইসকনসিনে পিজিএ চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দিতে। সেখানেই এই বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছেন নির্বাণ। তার পরেই কলকাতায় এলেন সেরা বাঙালির পুরস্কার নিতে। তাঁর হাতে খেলায় সেরা বাঙালির পুরস্কার তুলে দিলেন আর এক সেরা, বিশ্বজয়ী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। একাদশতম সেরা বাঙালি অনুষ্ঠানের গোপন নিয়ম তো এটাই। বিগত সেরারা পুরস্কার তুলে দেবেন এ বারের সেরাদের হাতে।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যাঁকে সেরার পুরস্কার দিলেন, তিনি রোজ সকালে রেওয়াজে বসেন। পুরিয়া ধানেশ্রী তাঁর প্রিয় রাগ। এ বারের সাহিত্যে সেরা বাঙালি, কলকাতাকে নিয়ে ‘আফটারনুন রাগা’ বা ‘মর্নিং রাগা’র মতো উপন্যাসের লেখক অমিত চৌধুরী। সেরা বাঙালি-র ব্যাকগ্রাউন্ডেও এ দিন ধ্রুপদী সঙ্গীতের মেজাজ। অনুষ্ঠানের শুরুতে উস্তাদ রাশিদ খানের গান। তার পর গণেশ হালুইয়ের হাতে শিল্পকলায় সেরা বাঙালির পুরস্কার দিলেন যিনি, তিনিও রেওয়াজনিষ্ঠ ক্লাসিকাল গায়ক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুগত মারজিৎ। এই সঙ্গীতপ্রেম কি জিনে থাকে?
অমিত চৌধুরীর সঙ্গীতপ্রেম সম্ভবত জেনেটিক। মা বিজয়া চৌধুরী রবীন্দ্রসঙ্গীতে একদা সাড়া জাগানো গায়িকা ছিলেন। তবে জিন তো শুধু সঙ্গীতপ্রেম দেয় না। সম্ভাবনার নিরিখে হয়তো এক দিন অঙ্ক কষে বলে দেওয়া যাবে, কোন বংশগত অসুখে কার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটা। জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে জিনতত্ত্বের বিজ্ঞানী অরবিন্দ চক্রবর্তীই যে এ বার বিজ্ঞানে সেরা বাঙালি। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা, নিজেও একদা সেরার সম্মানে সম্মানিত বিজ্ঞানী সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়।
যেমন বলা যায় না, কারা আগুন লাগায়! রাজনৈতিক ক্ষমতার সঙ্গে সহবাস করতে করতে হেনরিক হফগেন কখন হয়ে ওঠে মেফিস্টো! ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ থেকে ‘মেফিস্টো’, ‘রাজা লিয়ার’ থেকে ‘যারা আগুন লাগায়’-এর মতো নাটকের পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়ের হাতে নাটকে সেরার পুরস্কার তুলে দিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত। পাশে দাঁড়িয়ে তখন প্রাণ খুলে হাসছেন সঞ্চালিকা স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। তার পরও কিছু বাকি রহিয়া গেল। স্কোয়াশে গত দশ বছর ধরে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, অধুনা বিশ্ব র্যাঙ্কিং-এ ২৫তম খেলোয়াড়ও, এক বাঙালি সৌরভ ঘোষাল। দেওয়ালের সঙ্গে র্যাকেট নিয়ে এই খেলা এখনও এই বঙ্গে তেমন পরিচিতি লাভ করেনি। কিন্তু বাঙালি বিশ্বপ্রতিভা থেমে থাকেনি। সেরা প্রতিভার পুরস্কার সৌরভের হাতে তুলে দিলেন অপর্ণা সেন।অভিনয়ে সেরার খেতাব ঋত্বিক চক্রবর্তীর। ‘শব্দ’ ছবির অভিনেতা সম্প্রতি ‘অনুব্রত ভাল আছো’র জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছেন। তিনি ছাড়া কার হাতেই বা সেরার পুরস্কার তুলে দিতে পারতেন বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অবিসম্বাদিত ‘বুম্বাদা’? নির্বাক ছবি ‘আসা যাওয়ার মাঝে’তেও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। সেই ছবির পরিচালক আদিত্যবিক্রম সেনগুপ্তই এ বার সিনেমা পরিচালনায় সেরা বাঙালি। আবির্ভাবেই যিনি মাত করে দিয়েছেন ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চ। তাঁর হাতে এ দিন পুরস্কার তুলে দিলেন ‘ভিকি ডোনর’-‘পিকু’র মতো মনোহারী ছবির পরিচালক সুজিত সরকার। সঞ্চালক জিজ্ঞেস করেছিলেন, কখনও জিৎ-কোয়েলদের নিয়ে বাণিজ্যিক ছবি বানাবেন? স্বল্পভাষী আদিত্যবিক্রমের উত্তর, ‘‘জানি না। কখন কী ঘটবে কিছুই বলা যায় না।’’
ন’জন পুরস্কারপ্রাপকের মধ্যে এক জনই নারী। তিনিই সেরার সেরা। এবং তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিতে হাজির হওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বারের সেরা চমক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy