রাজ্য জুড়ে শাসক দলের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে রবিবার ব্যান্ডেল মোড় থেকে চুঁচুড়া ঘড়িমোড় পর্যন্ত মিছিল সিপিএম-এর। ছবি: তাপস ঘোষ।
গত ৬ বছরের মধ্যে এ বারের পুরভোটেই প্রথম বামেদের রক্তক্ষরণ কিছুটা বন্ধের ইঙ্গিত ধরা পড়েছে। কিন্তু তাতেই সমস্যা মিটে গিয়েছে বলে আদৌ মনে করছে না আলিমুদ্দিন। শাসক দলের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সক্রিয় ভূমিকায় বাইরে বেরোলেই সন্ত্রাসের মুখে পড়তে হবে, এই আতঙ্কে দলের বড় অংশ এখনও ভুগছে। আগামী বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে এই আতঙ্কের মনোভাব ছেড়ে বেরোনোর জন্য দলে কড়া সতর্কতা জারি করেছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র।
পুরভোটে রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়ার ঘটনাকে হাতিয়ার করে এখন থেকেই বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতিতে নেমে পড়ার জন্য দলের সদ্যসমাপ্ত রাজ্য কমিটির বৈঠকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। সেই একই বৈঠকে পেশ করা সূর্যবাবুর রিপোর্টে কিন্তু দলের একাংশের জন্য যথেষ্ট কড়া বার্তাও রয়েছে। পুরভোটের ফলাফলে বামেদের জন্য যে কিছু ইতিবাচক প্রাপ্তি আছে, তা মেনে নিয়েই সিপিএমের নতুন রাজ্য সম্পাদক মূলত দু’টি দুর্বলতা এ বার চিহ্নিত করে দিয়েছেন দলের নেতা-কর্মীদের জন্য। প্রথমত, শাসক দলের অত্যাচার, গা-জোয়ারি বাড়ছে, এটা ঘটনা। কিন্তু তার জেরে বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়ে দলের নেতা-কর্মীদের একাংশ নিজেদের স্বাভাবিক কাজকর্ম বন্ধ করে দিচ্ছেন। আর দ্বিতীয়ত, পুরসভা বা স্থানীয় প্রশাসনেও বিরোধীদের কিছু ভূমিকা থাকে। বহু জায়গাতেই বামেরা বিরোধী হিসাবে স্থানীয় সমস্যা ধরে ধরে সেই সক্রিয়তা দেখাতে ব্যর্থ। এ সবের ফলেই তৃণমূলের প্রতি ক্ষোভ বাড়লেও বামেদের প্রতি সেই অনুপাতে মানুষের আস্থা ফিরছে না বলে দলের অন্দরে সূর্যবাবুর বিশ্লেষণ।
শাসক দল তৃণমূলের একচেটিয়া সাফল্যের মধ্যেও এ বারের পুরভোটে বামেদের রক্তপাতের স্রোত যেমন থেমেছে, তেমনই লোকসভা ভোটের সময় থেকে রাজ্য রাজনীতিতে দ্রুত উঠে আসতে থাকা বিজেপির গতিও ধাক্কা খেয়েছে। এই জোড়া স্বস্তির তথ্য হাতে নিয়ে বিধানসভা ভোটের প্রস্তুতি শুরু করার সময়ে সংগঠনের দুর্বলতা কাটাতে এখন মরিয়া সূর্যবাবুরা। দলের রাজ্য কমিটির কাছে রাজ্য সম্পাদকের প্রখর আত্মসমালোচনামূলক রিপোর্ট সেই বার্তাই দিচ্ছে বলে সিপিএম সূত্রের ব্যাখ্যা। রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে: ‘শাসক দলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বৃদ্ধি এবং মোহ অনেকটা কাটলেও বামপন্থীরা এখনই সমানে সমানে লড়ে তাদের পরাস্ত করতে পারবে, মানুষ সে ভরসা পুরোপুরি করছে না। মানুষ আমাদের লড়াকু ভূমিকা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে। একই সঙ্গে কোথাও কোথাও প্রতিবাদ বা বিরোধিতা হলেও তাকে সংগঠিত রূপ দেওয়ার মতো অবস্থা নেই। শাসক দল ছেড়ে বামপন্থীদের প্রতি সমর্থন ফিরিয়ে আনার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরি করা যায়নি’।
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীরএক প্রবীণ সদস্যের কথায়, ‘‘আগের চেয়ে আমাদের অবস্থার অবশ্যই উন্নতি হয়েছে। বিজেপি নয়, বামপন্থীরাই যে তৃণমূলের একমাত্র বিকল্প, মানুষ ধীরে ধীরে তা বুঝতে পারছেন। কিন্তু মানুষের মনে পুরোপুরি আস্থা ফেরাতে আরও অনেক দূর যাওয়া দরকার।’’ দলের রাজ্য নেতৃত্বই বলছেন, এ বার পুরভোটে কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশ, হুগলি বা বীরভূমে শাসক দলের দৌলতে বহু জায়গাতেই নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু উপর তলা থেকে বারবার প্রতিরোধের কথা বলা সত্ত্বেও কিছু জায়গা ছাড়া অন্যত্র নিচু তলার কর্মীরা সেই আহ্বানে সে ভাবে সাড়া দেননি।
রাজ্য সম্পাদকের রিপোর্টেই বলা হয়েছে, সরকারে থেকে বিভিন্ন ক্লাব ও প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সুবিধা পাইয়ে দিয়ে শাসক দল তৃণমূল এমনিতেই তরুণ প্রজন্মের বড় অংশকে নিজেদের পক্ষে ধরে রেখেছে। এই প্রতিকূলতার মধ্যে আবার বামেদের একাংশ নিজেদের আখের বাঁচাতে তৃণমূলের সঙ্গে স্থানীয় স্তরে তলে তলে সমঝোতা করেও চলছে! যার ফল টের পাওয়া যাচ্ছে ভোটের সময়। রাজ্য নেতৃত্ব প্রতিরোধের ডাক দিলেও বেশ কিছু জায়গায় নিচু তলার সাড়া এখনও মিলছে না। স্থানীয় মানুষের মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও দেখা যাচ্ছে বুথে বামেদের এজেন্ট নেই, এলাকায় কাজ করার কর্মী নেই, কোথাও কোথাও প্রার্থীও ভোটের দিন বেপাত্তা! সব ক্ষেত্রে সন্ত্রাসই এর একমাত্র কারণ নয়!
রিপোর্টের ভাষায়, ‘প্রত্যক্ষ সন্ত্রাস সর্বত্র হয়নি। কিন্তু ভয়ভীতিতে সংগঠনের অনেকে কাবু হয়ে পড়ায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে সঞ্চিত ক্ষোভ ঠিক পথে প্রবাহিত করা যায়নি। মানুষের আস্থাভাজন হওয়ার মতো রাজনৈতিক-সাংগঠনিক তৎপরতার অভাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে’। বলা হয়েছে, পুর-পরিষেবা বা স্থানীয় প্রশ্নে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ‘ধারাবাহিক ভাবে লেগে থাকার কাজ’ বিরোধীরা ঠিক ভাবে করতে পারেনি। অথচ ‘ঠিকাদার পরিবৃত’ হয়েও শাসক দলের পুর-প্রতিনিধিদের এলাকায় কর্মতৎপরতা বেশি দেখেছেন মানুষ।
বিরোধী ভূমিকায় থেকে মানুষের দাবি নিয়ে আন্দোলন করলে সুফল যে পাওয়া যায় এবং সেই সক্রিয়তার রসদ কাজে লাগিয়েই সন্ত্রাস মোকাবিলা করা যায়, তা বোঝাতে শিলিগুড়ি পুরসভার ভোটের ফলকেই দলের অন্দরে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাচ্ছেন সূর্যবাবুরা। শিলিগুড়িতে শাসক দলের দুর্নীতি ও অপকর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে বলেই ভোটের সময় মানুষ বামেদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, এমনই দেখানো হয়েছে রিপোর্টে। বলা হয়েছে: ‘কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পুরসভায় বিরোধী পক্ষে থাকা অবস্থায় স্থানীয় সমস্যা বা দাবিগুলি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনও প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি।... যেখানে স্থানীয় ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে, স্থানীয় ভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কিছুটা হয়েছে এবং পার্টি ও গণফ্রন্টের কাজ সাধারণ ভাবে চালু রয়েছে, সেখানে আমাদের ফলাফলের উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে’।
শিলিগুড়ির সাফল্য সামনে রেখেইবিধানসভা ভোটের আগে দলের জন্যরাজ্য নেতৃত্বের হুঁশিয়ারি— ‘দুর্বলচেতা,নিষ্ক্রিয় ও দোদুল্যমান চিত্তের কর্মী ও নেতাদের সংখ্যা কম নয়। পার্টি সংগঠনে এদের অবস্থিতি লড়াকু সংগঠনের সারবত্তায় ক্ষতি করে’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy