বরুন বিশ্বাসের মৃত্যুর পর তাঁর মূর্তি বসেছে সুটিয়ায়। তৈরি হয়েছে বিশ্বাসবাড়ি বাসস্টপ। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের গ্রেফতারির পর সেখানে আলোচনায় প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্যরা। —ফাইল চিত্র।
তখন ঘোর বাম আমল। তার মধ্যেই কি মেঘ ঘনিয়েছিল বরুণ বিশ্বাস আর তৎকালীন গাইঘাটা কেন্দ্রের বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সম্পর্কে? বরুণের লেখা একটি চিঠিতে তেমনই আভাস মিলেছে। চমৎকার, স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা সেই চিঠিতে (আনন্দবাজার যার সত্যতা যাচাই করেনি) জ্যোতিপ্রিয়ের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনেছিলেন বরুণ। বলেছিলেন, জ্যোতিপ্রিয় কোনও দিন কোনও নির্যাতিতার খোঁজও নেননি। একই সঙ্গে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেন, যা যে-কোনও মান্য ব্যক্তির জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয় না।
যদিও এর অনেক পরে খুন হন বরুণ। কিন্তু তাঁর উপরে হামলা আগেও হয়েছে। সে সবই কি তা হলে প্রতিবাদী এবং বিধায়কের ফল্গু ধারার মতো বয়ে যাওয়া ঠান্ডা লড়াইয়ের ফলে? নাকি তাতে কোনও রকম যোগ ছিল তৎকালীন শাসক দল সিপিএম এবং স্থানীয় দুষ্কৃতীদের?
২০০৪ সালে সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে লেখা সেই চিঠিতে বরুণ লেখেন, ‘গাইঘাটার মাননীয় বিধায়ক শ্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গত দু’বছর ধরে প্রতিবাদী মঞ্চের আন্দোলনকে থামিয়ে সমাজবিরোধীদের জয়রথের সারথি হতে চেয়েছেন। সমাজবিরোধীদের নিয়ে কয়েকটি প্রকাশ্য সমাবেশও করেছেন। আজ পর্যন্ত তিনি একটি ধর্ষিতা মেয়েরও খোঁজ নেননি। একটি কেস সম্পর্কেও অবহিত নন। আন্দোলনকারী কারও সঙ্গে সম্পর্ক নেই। অথচ, সংবাদমাধ্যমকে বার বার জানিয়েছেন, তাঁর জন্যই সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ বরুণ এ-ও লিখছেন, ‘মিথ্যা ও ভন্ডামী এবং জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ক্রমশ সমার্থক হয়ে উঠছে। তাঁর চৈতন্যোদয় কামনা করি (মূল বানান ও বাক্যবিধি অপরিবর্তিত)।’
ঘটনাচক্রে, ২০০১ সালে গাইঘাটা থেকে তৃণমূলের টিকিটে জিতে একটি ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করেছিলেন জ্যোতিপ্রিয়। সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দার বলেন, ‘‘এক বছরের মধ্যে দলের কয়েক জন বিধায়ককে এনে সুটিয়ায় যে শান্তি কমিটি গড়েছিলেন জ্যোতিপ্রিয়, তাতে ঠাঁই পেয়েছিল স্থানীয় দুষ্কৃতীরা। এলাকার মানুষ তা ভাল চোখে দেখেননি। মানুষের চাপে অচিরেই ভেঙে যায় সেই কমিটি।’’ বরুণের চিঠিতে ঠিক এই নিয়েই অভিযোগ তোলা হয়েছিল।
একই সঙ্গে আতশকাচের তলায় আসে তৎকালীন শাসক দল সিপিএমের ভূমিকা। বরুণ তাঁর চিঠিতে লিখেছেন, ‘এক দিকে সমাজবিরোধীদের সন্ত্রাস ও খুনের হুমকি, অন্য দিকে পুলিশ রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের নিষ্করুণ ঔদাসিন্য; সর্বোপরি সমাজবিরোধীদের সঙ্গে পুলিশ ও নেতাদের প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতা সাধারণ ও নির্যাতিত মানুষকে হতাশ করে তুলেছিল। তাঁরা কোথাও অভিযোগ জানানোর সাহস পায়নি। প্রসঙ্গত, সমাজবিরোধীর দলটি প্রকাশ্য রাস্তায় ২০/২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াত।’
চিঠির এই ভাষ্যেই স্পষ্ট, স্থানীয় পর্যায়ে নেতা-দুষ্কৃতীর সঙ্গে পুলিশের যোগসাজশের অভিযোগ করে গিয়েছেন বরুণ স্বয়ং। ননীগোপাল এখন বলছেন, ‘‘স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্ব আমাদের সহযোগিতা করেননি। জ্যোতিপ্রিয়রাও পাশে ছিলেন না।’’ তবে একই সঙ্গে সুটিয়ায় গণধর্ষণে অভিযুক্তদের পাকড়াওয়ের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও ধন্যবাদ দিয়েছেন বরুণ, তাঁর ওই চিঠিতে। সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রমেন আঢ্য জানান, রাজ্যের তৎকালীন মন্ত্রী কান্তি বিশ্বাসকে নিয়ে তাঁরা বহু বার সুটিয়ায় মিটিং-মিছিল করেন। তাঁর আরও দাবি, ‘‘যে ধরনের সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছিল, তাতে আমাদের স্থানীয় ছোটখাটো নেতারাও ভয়ে ভয়ে ছিলেন।’’ তৃণমূলেরও দাবি, তারা সুটিয়ার মানুষের লড়াইয়ের পাশেই থেকেছে। গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি গোবিন্দ দাস বলেন, ‘‘জ্যোতিপ্রিয় এবং আমি বহু মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সুটিয়ায় আন্দোলন করেছিলাম। এখন ওরা মিথ্যা বলছে।’’
সকলেই যদি পাশে ছিলেন, তবে বরুণকে সুটিয়া মামলার এত বছর পরে মারল কে এবং কেন— সে প্রশ্নের সমাধান হল না আজও।
বরুণের মৃত্যুর পরে তাঁকে সরাসরি তৃণমূলের লোক বলে দাবি করে বসেন জ্যোতিপ্রিয়। একটি মানবাধিকার সংগঠনের চাঁদপাড়া শাখার সভাপতি নন্দদুলাল দাস বলেন, ‘‘বরুণের মৃত্যুর পরে মন্ত্রিসভার কয়েক জনকে সুটিয়া বারাসত পল্লি উন্নয়ন বিদ্যাপীঠের মাঠে এনে সভা করেন জ্যোতিপ্রিয়। সেখানে দাবি করেছিলেন, বরুণ তাঁদের দলেরই লোক।’’
সে দিন ওই সভায় গিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা সিবিআইয়ের প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা উপেন বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘ওই সভায় বরুণের পরিবারের লোকজন কেউ আসেননি। মঞ্চে কিছু ক্ষণ থাকার পর জ্যোতিপ্রিয় সেখান থেকে চলে গিয়েছিলেন।’’ উপেন আরও জানান, সে দিন নির্যাতিতাদের সঙ্গে কেউ কথা বলছিলেন না বলে, তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। কেন কথা বলেননি কেউ? উপেনের ব্যাখ্যা, ‘‘মঞ্চ থেকে নেমে তাঁদের সঙ্গে কেউ কথা বলার সাহস দেখাননি। পরে আমি স্ত্রীকে বলি, নীচে গিয়ে নির্যাতিত মহিলাদের সঙ্গে কথা বলতে। সেই সময়ে জ্যোতিপ্রিয়ের প্রতি নির্যাতিতারা ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন।’’
বনগাঁ মহকুমা আদালতে কী অবস্থায় আছে বরুণ খুনের মামলা? ২০০৩ ও ২০১১ সালে ননীগোপাল পোদ্দারকে নিশানা করেও দু’বার গুলি চালায় দুষ্কৃতীরা। কী অবস্থা সেই তদন্তের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy