Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
শিল্পাঞ্চলে দাদা-তন্ত্র
Barrackpore

অশান্তির সঙ্গে বাস, বীজ বুনছে অন্য দ্বন্দ্বও

পুলিশি তথ্যও বলছে, লকডাউনে কিছু দিন একটু শান্ত থাকার পরে, গত তিন-চার মাসে এই শিল্পাঞ্চলে অপরাধের হার বেড়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রচুর তাজা বোমা।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

সন্দীপন চক্রবর্তী  ও সুপ্রকাশ মণ্ডল
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২০ ০৩:৩২
Share: Save:

রাজনীতির হাওয়া বদল, রাজনীতির কুশীলবদের দল বদলেও দাদাদের দৌরাত্ম্য যে কমে না, তার সাক্ষী সাম্প্রতিক কালের ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল। বরং, ‘ভুক্তভোগী’ বলাই ভাল! এলাকার বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা বলছে, গত দেড় বছর ধরে কার্যত বারুদের স্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া, জগদ্দলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

পুলিশি তথ্যও বলছে, লকডাউনে কিছু দিন একটু শান্ত থাকার পরে, গত তিন-চার মাসে এই শিল্পাঞ্চলে অপরাধের হার বেড়েছে। উদ্ধার হয়েছে প্রচুর তাজা বোমা। গত দেড়-দু’বছর ধরেই তেতে রয়েছে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল। তবে শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দারা হাড়ে হাড়ে জানেন, ‘খুচরো অপরাধ’ কোনও দিনই কমেনি ব্যারাকপুরে।

ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিট পাচ্ছেন না বুঝে ২০১৯-এর মার্চে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ভাটপাড়ার তৎকালীন বিধায়ক অর্জুন সিংহ। তখনই শুরু নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের। এক দিকে ‘বাহুবলী’ অর্জুনের নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের লড়াই। অন্য দিকে, শাসক দলের নিজেদের গড় টিকিয়ে রাখার লড়াই। শুরু হল লাগাতার বোমাবাজি, গুলি, আগুন জ্বলল একাধিক জায়গায়।

অর্জুনের ছেড়ে যাওয়া বিধানসভা আসনে উপনির্বাচনের দিন এলাকা দেখেছিল দু’পক্ষের রক্তক্ষয়ী লড়াই। ভোটের দিন মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়েছিল। জ্বলেছিল পুলিশের গাড়ি। সেই লড়াই আর থামেনি। অভিযোগ, পুরো এলাকাই চলে গিয়েছিল সমাজবিরোধীদের হাতে।

মে মাসে ফল প্রকাশের রাত থেকে টানা আড়াই মাস কার্যত অবরুদ্ধ ছিল কাঁকিনাড়া-ভাটপাড়া। প্রথমেই বেদখল হয় তৃণমূলের প্রায় ২০০টি দলীয় কার্যালয়। তৃণমূলের কাউন্সিলর-সহ তিনটি পুরসভা প্রায় রাতারাতি দখল করে বিজেপি। তার পর থেকেই শিল্পাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে শুরু হয় নৈরাজ্য। রাস্তা জুড়ে তার পর থেকে শুধু সমাজ-বিরোধীদের দাপাদাপি দেখেছে কাঁকিনাড়া-ভাটপাড়া এবং আশপাশের এলাকা।

কাঁকিনাড়া বাজারের ব্যবসায়ী বিজয় পাসোয়ান বলেন, ‘‘প্রায় তিন মাস বাজারে কোনও দোকান খুলতে পারিনি আমরা। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ঘোষপাড়া রোডে বাস পর্যন্ত চালাতে সাহস পাননি মালিক-কর্মীরা।’’ ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, সেই সময় বহু দোকান লুট হয়েছে। পুলিশ দোকান খুলতে গেলে তাদের লক্ষ্য করে বোমা-গুলি চলেছিল বলে অভিযোগ। গুলিতে মৃত্যু হয় দুই স্থানীয় বাসিন্দার। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা এক রকম জোর করেই পথে নামেন।

স্থানীয় বাসিন্দা এবং ব্যবসায়ীদের মতে, অর্জুন যখন শাসক দলের বিধায়ক এবং ভাটপাড়া পুরসভার চেয়ারম্যান, তখন প্রশাসন তাঁর হাতের মুঠোয় ছিল। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই ঘটানোর সাহস কারও ছিল না। দল বদলে তিনি সাংসদ হয়েছেন, ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন হয়েছে কিন্তু সরকারে থাকার সেই সুবিধা আর তাঁর নেই। গড় দখল বা ধরে রাখা, অথবা ‘হিসেব চোকানো’র লড়াই— সবই এখন ভয়ঙ্কর। টিটাগড়ে মণীশ শুক্লকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে হত্যা সেই ভয়ানক পরিস্থিতিরই আরও এক আয়না বলা যেতে পারে।

ব্যবসায়ীরা দোকান-পাট খুলেছেন এখন। কিন্তু সমস্যা মেটেনি। এই সে দিনও সামান্য বচসার জেরে জগদ্দলে এক কিশোর স্কুল-পড়ুয়াকে গুলি করে খুন দুষ্কৃতীরা। সামনে বিধানসভা ভোট। ফলে সমাজ-বিরোধীদের কদর বেড়েছে যুযুধান সব পক্ষেই।

শিল্পাঞ্চল জুড়ে এই না-বদলানোর ছবির মধ্যেও বদল একটা ঘটছে। ভিন্ রাজ্য থেকে আসা বেপরোয়া লোকজন, হিন্দিভাষীদের দাপট এমন ভাবে বেড়েছে, যার জেরে ভাষাগত বিভাজনের শিকড় ছড়াচ্ছে। এলাকারই এক নেতার কথায়, ‘‘শিল্পাঞ্চলে নানা ভাষার লোকজন মিলে-মিশে থেকেছেন চিরকাল। অপরাধ থাকলেও অপরাধীরা এ ভাবে ছড়ি ঘোরায়নি। এখন আর দুষ্কৃতীদের সাহায্য নিয়ে রাজনীতিকে চলতে হয় না, দুষ্কৃতীরাই রাজনীতি চালায়!’’

অন্য বিষয়গুলি:

Barrackpore Goons
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy