কুলকামিনী স্কুলে মিষ্টিমুখ শিক্ষক-পড়ুয়াদের।
তিন বছর পরে ঘরে ফিরলেন মাস্টারমশাই।
বুধবার মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা, রোজকার ক্লাসের মাঝে পারুলিয়া কুলকামিনী উচ্চ বিদ্যালয়ে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় খবর। এই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রদীপ সাহা।
এ দিন সাড়ে ১১টার কিছু পরে স্কুলের কিছু প্রাক্তন ছাত্র প্রথমে রায় জানতে পারে। সঙ্গে সঙ্গেই হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। শিক্ষকেরা জড়ো হন। শুরু হয়ে যায় মিষ্টি খাওয়ানো। স্কুল চত্বরে যারা ঘোরাফেরা করছিল তাদেরও মিষ্টি বিলি করা হয়। এতদিনের খোলস থেকে যেন বেরিয়ে আসে স্কুল।
স্কুলের সহ-প্রধান শিক্ষক সুব্রত সামন্ত বলেন, “প্রদীপবাবু আমাদের ছাতার মতো ছিলেন। শিক্ষক-ছাত্র সবার পাশে দাঁড়াতেন। কিন্তু রাজনীতির শিকার হয়ে জেলে যেতে হয় তাঁকে। আজ মনে হচ্ছে আবার মাথার ছাতা ফিরে এল।” তিনি জানান, প্রদীপবাবু এ স্কুলের জন্য প্রচুর করেছেন। যে রাতে তিনি গ্রেফতার হন, সেই দিনই স্কুলে প্রথম মিড-ডে মিল চালু হয়। উনিই সব ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন।
প্রদীপবাবু গ্রেফতারের পরে এই স্কুল থেকে প্রথম প্রতিবাদ করা হয়। পড়ুয়ারা মিছিল করে, বিক্ষোভ দেখায়। সঙ্গে ছিলেন কিছু শিক্ষকও। এ দিন শিক্ষকেরা দাবি করেন, জেলে থাকার প্রত্যেক দিন স্কুল তাঁর পাশে ছিল, তাঁর অপেক্ষায় ছিল। ঘটনার বছর অর্থাত্ ২০১২ সালে স্কুল পরিচালন সমিতির নির্বাচনে সিপিএম জেতে। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে কালেখাঁতলা ১ পঞ্চায়েত এলাকার সব আসন পায় সিপিএম। সবটাই প্রদীপ সাহার প্রতি সহানুভূতি, বিশ্বাস বলে স্কুল শিক্ষক ও স্থানীয় মানুষজনের দাবি। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০২ সালে স্কুলের দায়িত্ব নেন প্রদীপবাবু। তারপর থেকেই উন্নতি শুরু হয়। ইতিহাসের শিক্ষক ইয়ানুস আলি শেখ বলেন, “আমরা জানতাম ন্যায় বিচার হবে। আমাদের প্রধান শিক্ষক এর সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন না। জানতাম, তিনি ফিরবেনই।” আর এক শিক্ষিকা তনয়া বসু বলেন, “আমার বাবা এসআই ছিলেন। বাবার কাছে শুনেছি স্কুলের তহবিলের জন্য রাইটার্সে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন প্রদীপবাবু।” একাদশ শ্রেণির ছাত্র, সৌম্য মজুমদার বলেন, “আমরা জানতাম, স্যার ফিরবেনই। এখন কত তাড়াতাড়ি স্কুলে আসবেন তারই অপেক্ষা করছি।”
স্কুলের পাশের একটি ক্লাব মৈনাক সঙ্ঘও মিষ্টি বিলি করে এলাকায়। ক্লাবের এক সদস্য শুভ কর্মকার বলেন, “মামলার গতি কোন দিকে যাচ্ছে দেখতে খবরের কাগজে চোখ থাকত। বিশ্বাস ছিল উনি কখনই এমন কাজে যুক্ত থাকতে পারেন না। সেটাই প্রমাণ হল।”
এ দিনের রায়ে সিপিএমও যেন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। পারুলিয়া বাজারে আবির খেলা হয়। বিকেলে সভারও আয়োজন করেছিল সিপিএম। প্রদীপ সাহাকে কৃষ্ণনগর সংশোধনাগার থেকে ওখানেই আনা হবে বলে জানান সিপিএমের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। শুধু পূর্বস্থলী নয়, আশপাশের এলাকা থেকেও ভ্যানে-গাড়িতে করে নেতাকর্মীরা জড়ো হয়েছেন। তাঁদের দাবি, “চক্রান্ত প্রমাণ হয়ে গেল।”
স্কুল থেকে কিলোমিটার দুয়েক দূরে পারুলিয়া দক্ষিণ পাড়ায় প্রদীপবাবুর বাড়ি। বাবা মণীন্দ্র সাহা ও মা দিপালীদেবী এই বাড়িতেই থাকেন। পাশেই বাড়ি মিনতি বিশ্বাসের। তিনি বলেন, “ছাত্রদের গায়ে হাত তুলতেও যাঁর হাত কাঁপত, তিনি বন্দুক ধরবেন বিশ্বাসই করতে পারিনি। মাঝে কয়েক বছর কেটে গেলেও প্রমাণ হয়েছে উনি নির্দোষ।” আর এক প্রতিবেশি মমতা সাহা বলেন, “এলাকায় ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন প্রদীপবাবু। প্রায় প্রতিদিনই খোঁজ রাখতাম। পুজো করতে করতে মাধেমাধ্যেই ওঁর বাবা-মায়ের কান্না শুনতে পেতাম। বোঝাতাম আমরা। আজ স্বস্তি পেলাম। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবে এ বার।” প্রদীপবাবুর বাড়িতেই থাকতেন রাকেশ সাহা। বর্তমানে কুলকামিনী স্কুলের পার্শ্বশিক্ষক তিনি। এ দিন বলেন, “আমাকে ভালবেসে নিজের বাড়িতে রেখেছিলেন স্যার। যে দিন থেকে গ্রেফতার হয়েছেন তারপর বহু রাত ঘুমোতে পারিনি। আজ নিশ্চিন্ত হলাম। যা হয়েছি ওনার জন্যই।”
বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy