Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Purbasthali

সত্তরেও ক্লান্তিহীন, স্কুলই মহামায়ার সংসার

১৯৭৪-এ এসটিকেকে রোডের পাশে গড়ে ওঠে স্কুলটি। তার ১২ বছর পরে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর সরকারি অনুমোদন পায় স্কুল। এখন সেখানে পড়ানো হয় দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত।

পড়ুয়াদের সঙ্গে শিক্ষিকা মহামায়া।

পড়ুয়াদের সঙ্গে শিক্ষিকা মহামায়া। —নিজস্ব চিত্র।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:২৩
Share: Save:

বয়স ৭০ ছুঁইছুঁই। চার দশক স্কুলে পড়ালেও পাকা হয়নি চাকরি। তাতে বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। এখনও নিয়ম করে স্কুলে আসেন। স্কুলই তাঁর সংসার। ছাত্রীরা তাঁর কন্যাসম। পূর্বস্থলী ১ ব্লকের জালুইডাঙা গোপালচন্দ্র পাল উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা মহামায়া মালাকার অবসরের কথা ভাবতেও পারেন না। বার্ধক্যেও কালনার ধাত্রীগ্রামের মহামায়াকে গ্রাস করতে পারেনি ক্লান্তি।

১৯৭৪-এ এসটিকেকে রোডের পাশে গড়ে ওঠে স্কুলটি। তার ১২ বছর পরে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর সরকারি অনুমোদন পায় স্কুল। এখন সেখানে পড়ানো হয় দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। ছাত্রীর সংখ্যা ৬০০। ১৯৮৩-এ মার্চ থেকে স্কুলে পড়ানো শুরু করেন সংস্কৃত অনার্স নিয়ে পাস করা কালনা কলেজের ছাত্রী মহামায়া। পরে বিএড ডিগ্রিও অর্জন করেন। স্কুল সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পরে, তাঁর সঙ্গে স্কুলের পাঁচ জনের চাকরি স্থায়ী হলেও চাকরি পাকা হয়নি মহামায়ার।

স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে আসা মহামায়াকে বাসভাড়া ও টিফিনের খরচ বাবদ স্কুলের তহবিল থেকে মাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হত এক সময়ে। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার টাকা। স্কুলের শিক্ষিকারা জানান, কোনও কোনও সময় বাস না মিললে অন্য যানবাহন ভাড়া করে বাড়ি ফিরতে হয় তাঁকে। তবে তা নিয়ে আক্ষেপ নেই মহামায়ার। কোনও দিন তিনটি, কোনও দিন চারটি ক্লাস নিয়ে বাড়ি ফেরেন।

এক সময়ে স্কুলে করণিক পদ ফাঁকা ছিল। ক্লাস নেওয়ার পরে মহামায়া করণিকের কাজও করতেন। স্বামীর স্বল্প আয়ে দুই মেয়ের পড়াশোনা এবং সংসারের খরচ চালানো সম্ভব না হওয়ায় প্রয়োজন ছিল বাড়তি অর্থের। রোজগার বাড়াতে মহামায়া স্কুল ছুটির পরে ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। সন্ধ্যা ৭টার বাস ধরে ফিরতেন বাড়ি। ১২ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। দুই মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করে তাঁদের বিয়ে দিয়েছেন। এখন একাই থাকেন। যদিও একাকিত্ব অনুভব করেন না মহামায়া। জানতে চাইলে বলেন, ‘‘একা হব কেন! স্কুলই তো আমার সংসার। শ্রেণিকক্ষে পৌঁছলেই শরীরে জোর চলে আসে। যতদিন পারব পড়িয়ে যাব।’’

স্থায়ী চাকরি না পাওয়ার আক্ষেপ নেই?

চোয়াল শক্ত করে মহামায়া বললেন, ‘‘অর্থ দিয়ে তো সব কিছু মাপা যায় না। এক সময় স্থায়ী চাকরির আশা ছিল ঠিকই। তবে হয়নি বলে স্কুলে আসা ছেড়ে দেব, এমন কখনও ভাবিনি। তা ছাড়া, স্কুল থেকে কিছুই যে পাইনি, তা-তো সত্য নয়। অনেক ছাত্রী তৈরি করেছি, যাঁরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।’’

কী পেলেন চার দশক শিক্ষকতা করে?

হেসে বললেন, ‘‘কিছুদিন আগে ভোট দিতে গিয়েছিলাম। এক মহিলা পুলিশকর্মী পা ছুঁয়ে প্রণাম করে আমাকে বলল, ‘দিদিমণি, চিনতি পারছ? আমি পায়েল’। বুকটা আনন্দে ভরে গিয়েছিল। এই প্রাপ্তি অমূল্য।’’
স্কুলের ছাত্রীরাও দিদি অন্ত প্রাণ। দ্বাদশ শ্রেণির তন্দ্রা বসাক, পার্বতী বসাক, সপ্তম শ্রেণির পূর্বা নন্দী, শ্রাবন্তী মণ্ডলদের কথায়, ‘‘দিদির ক্লাস কোন দিন না হলে ভাল লাগে না। কখনও চক-ডাস্টার হাতে ব্ল্যাক বোর্ডে অঙ্ক কষে দেন। কখনও গড়গড় করে বলে যান সংস্কৃতের নানা শ্লোক।’’

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা মণিদীপা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন থাকলে তবেই উনি অনুপস্থিত থাকেন। স্কুলে স্থায়ী চাকরি হচ্ছে না দেখে উনি অন্য কোন কাজে যোগ দিতে পারতেন। পারেননি শুধু স্কুলকে ভালবেসে। উনি আদর্শ শিক্ষকের উদাহরণ। স্কুল ওঁর জন্য গর্বিত।’’ কালনা মহকুমা অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক জহরলাল প্রামাণিক বলেন, ‘‘ওঁর কথা আমি আগে শুনিনি। তবে খোঁজ নেব।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Para Teacher
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy