আসানসোল, রানিগঞ্জের কয়লাখনিতে কর্মরত কুলিকামিন, সাঁওতাল, বাউড়িদের যাপনচিত্র উঠে এসেছিল তাঁর লেখায়। কাজী নজরুল ইসলাম বেঙ্গল পল্টনে যোগ দিলেও নিজে যোগ দিতে না পেরে সেই শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ই আর রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে আর ফিরে আসেননি। বীরভূমে বাবার বাড়ি রূপসপুরে চলে যান। সেখানে নাকরাকোন্দা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন।
সম্প্রতি পার হয়েছে সাহিত্যিকের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী। অন্ডাল গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম হয়েছিল শৈলজানন্দের। ছ’বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পরে সেখানেই থেকে যান। অন্ডাল উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরে রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই সময় সিয়ারসোল রাজ উচ্চ বিদ্যালয়ে একই শ্রেণিতে পড়তেন নজরুল। সেই সূত্রে দু’জনের ঘনিষ্ঠতা। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুখপত্র বলে পরিচিত ‘তরুণ’ পত্রিকার সম্পাদক অন্ডাল গ্রামের বৈদ্যনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁদের পারিবারিক রানিগঞ্জের শ্মশান কালী মন্দিরে (বর্তমানে শহরের মাঝখানে বড় কালী মন্দির বলে পরিচিত) আড্ডা মেরেছেন। দু’জনেরই যাতায়াত ছিল সরস্বতী কর্ম মন্দিরে। সেখানে সাহিত্য চর্চার আড়ালে হত স্বাধীনতা সংগ্রামের অনুশীলন।
রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক তথা কবি বাসুদেব মণ্ডল চট্টোপাধ্যায় জানান, দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় নজরুল ও শৈলজানন্দ বেঙ্গল পল্টনে যোগ দিতে পরীক্ষা না দিয়ে চলে যান। কিন্তু, শৈলজানন্দকে তাঁর দাদু জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় প্রভাব খাটিয়ে চিকিৎসককে দিয়ে অসুস্থ (আনফিট) দেখিয়ে দেওয়ায় আর পল্টনে যোগ দেওয়া হয়নি। অভিমানে আর রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ফিরে আসেননি শৈলজানন্দ। রূপসপুর চলে যান। সেখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করে কলকাতার কাশিমবাজারে শর্টহ্যান্ড প্রশিক্ষণ নেন। এরপর জামুড়িয়ার জোড়জানকি কোলিয়ারিতে চাকরিতে যোগ দেন। জামুরিয়ার ইকরায় বিয়ে করেন। বরযাত্রী হিসেবে এসেছিলেন নজরুল ও তারাশঙ্কর। খনিতে কর্মরত অবস্থায় লেখেন খনি সংস্কৃতি বিষয়ক কালজয়ী সাহিত্য— ‘কয়লাকুঠি’।
সাহিত্য চর্চায় মন দিতে শৈলজানন্দ কলকাতায় দাদুর বাড়ি চলে যান। শোনা যায়, তাঁর এক মামার মৃত্যুর পরে লিখেছিলেন ‘আত্মঘাতির ডায়েরি’। তাতে দাদুর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় অন্যত্র চলে যেতে হয়। নজরুলকে নিয়ে অভিমানের সঙ্গে লিখেছেন ‘কেউ ভোলে কেউ ভোলে না’। ‘শহর থেকে দূরে’, ‘আনন্দ আশ্রম’ ছাড়াও বহু সিনেমায় পরিচালক, লেখক, অভিনেতার ভূমিকা পালন করেছেন।
তাঁকে নিয়ে প্রতি বছর অন্ডাল গ্রামে প্রগতি পাঠচক্রের উদ্যোগে ও অন্ডাল পঞ্চায়েতের সহযোগিতায় ১২৫ তম জন্মবার্ষিকীতে অনুষ্ঠান হয়। ২০১৬ সালে আবক্ষ মূর্তি, আচ্ছাদনও তৈরি হয়েছে। আয়োজক সংস্থার পক্ষে প্রাক্তন প্রধান রাজু রায় জানান, মূর্তির সামনের রাস্তার নাম ‘শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় সরণি’। আসানসোলের ‘এক ধাপ’ সাহিত্য গোষ্ঠীর সম্পাদক ফাল্গুনী চট্টোপাধ্যায় জানান, এ বছর প্রথম তাঁরাও স্মরণ অনুষ্ঠান করেন।
শৈলজানন্দের ভাগ্নে বিনয়েন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জানান, রূপসপুরে শৈলজানন্দের নামে পাঠাগার ও তোরণ আছে, নাকরাকোন্দায় আছে মহাবিদ্যালয়। শৈলজানন্দের মামাতুতো নাতি অন্ডালের প্রদ্যুৎ চট্টোপাধ্যায় জানান, তিনি শুনেছেন শৈলজানন্দের দাদুরা লাঠিয়াল হিসাবে কয়েক’টি পরিবারকে গ্রামে এনেছিলেন। পরে তাঁদের সঙ্গে ঝামেলা হয়। তাকে কেন্দ্র করেই নাকি ‘মহাযুদ্ধের ইতিহাস’ লেখেন শৈলজানন্দ। এতে দাদুর সঙ্গে মনোমালিন্য হলে শুরু হয় পৃথক বসবাস। রানিগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রতিম চট্টোপাধ্যায় জানান, সাহিত্যিকের নামে আগেই মূর্তি স্থাপন হয়েছিল। এ বার মহা সমারোহে ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)