বহূরূপী সাজে শিল্পীরা। বাঁ দিকে, কাটোয়ায়। ডান দিকে, বড়শুলে। নিজস্ব চিত্র
ছেলেবেলায় ‘বহুরূপী’ নামটা শুনলেই বুকের ভিতরটা কেমন ধড়াস করে উঠত। অনেকে ভয়ে মায়ের কোলের কাছে লুকোতাম। মনে হত, এই বুঝি কেউ খপ করে তুলে নিয়ে যাবে।
কিন্তু এখন সে দিন গিয়েছে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন ঘটেছে বিনোদন মাধ্যমেরও। অখণ্ড বর্ধমান, বীরভূম, নদিয়ার মতো বিভিন্ন জেলার গ্রামে একটা সময়ে দলে দলে যে বহুরূপীদের খোঁজ মিলত আজ তাঁরা অনেকেই বহুরূপী সাজা বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকেই অন্য কাজের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন। তবে নির্বাচন কাছে এলে একটু দৃষ্টি ফেরে এই শিল্পীদের দিকে। সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের প্রচারে মাঝেমধ্যে তাঁদের ব্যবহার করা হয়।
তবে ওটুকুই। আগে যে রকম গ্রামে, গ্রামাঞ্চলে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এক এক ধরনের সাজে উপস্থিত হতেন বহুরূপীরা, সে দিন কেটে গিয়েছে বেশ আগেই। বিশ্বায়নের যুগে ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হচ্ছে এই শিল্পটি। তার থেকেও বড় কথা, এই শিল্পের হাত ধরে বেঁচেছিল বাংলার নানা লোককথা, কিংবদন্তি আর লৌকিক দেবদেবীরাও। ছেলেবেলায় হামেশাই দেখেছি বহুরূপীদের কেউ কৃষ্ণ, কেউ বা বকাসুর সেজে কৃষ্ণজীবন অভিনয় করছেন। আবার কেউ বা সাজতেন শিব কেউ বা কালী। গল্প, উপন্যাসে বহুরূপীদের যে জীবনচিত্রের ছবি আমরা পাই তাতে দেখা যায়, এঁদের বেশিরভাগই সমাজের দরিদ্র পরিবার থেকে আসতেন। নিজেকে সাজানোর মতো রসদ তাদের ছিল সামান্যই। হয়ত আজকের পেশাদারি মেকআপের তুলনায় নেহাতই সাদামাটা। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেই সাজেই তাঁরা যুগের পর যুগ মনোরঞ্জন করে এসে ছেন বাংলার সাধারণ মানুষের।
বেশিরভাগ জায়গায়ই দেখা যেত, বহুরূপীদের রোজগার ছিল খুবই সামান্য। হয়ত বা সারা গ্রাম ঘুরে যত টাকা বা চাল, কলা তাঁরা পেতেন তাতে কোনও মতে এক আধবেলা খাওয়া যেত। তবে কোনও এক অদৃশ্য সুতোর টানে তাঁরা বছরের পর বছর বহুরূপী সাজতেন। গ্রামের রাস্তায় দেখা যেত, চিরাচরিত ঠাকুর, দেবতা বা লোককথার চরিত্রের পাশাপাশি, পুলিশ, পাগল, বাইজি কাপালিকের মতো সামাজিক চরিত্রদেরও। কোথাও কোথাও আবার তাঁদের অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটে উঠত বাস্তবের টুকরো ছবি।
তবে গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছোটরা রূপের আড়ালে থাকা মানুষটিকে চিনতে না পেরে ভয়ে পেত। অনেক সময় বহুরূপীরা অভিনয়, সাজসজ্জা, কলাকৌশলের নিপুণতায় ফাঁকি দিতেন বড়দের চোখকেও। সমরেশ বসুর ‘সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা’ গল্পে দেখা যায়, বহুরূপী সুচাঁদ কখনও হনুমান, কখনও বা কঙ্কাল সেজে গ্রামে গ্রামে খেলা দেখাতেন। তাঁর সাজসজ্জা দেখে কেউ ভয় পেলে তিনি আত্মপরিচয় দেওয়ার ঢঙে বলতেন, ‘‘আইজ্ঞা কর্তা ডইরাবেন না। আপনি সুচাঁদকে দেখতে আসেন।’’ একই ভাবে মনে পড়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের শ্রীনাথ বহুরূপীকে। এ ছাড়াও সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে ফুটে ওঠে শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ বিরাগী হরিদাসদের কথা।
তবে শুধু গ্রামাঞ্চলে নয়, একটা সময় কলকাতার মতো শহরেও দেখা মিলত বহুরূপীদের। পুরনো কলকাতার বহুরূপীদের প্রসঙ্গে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত জানান, বাতিওয়ালারা চলে যাওয়ার পরে অন্ধকার গাঢ় হলে পাড়ায় বহুরূপীদের দেখা মিলত। বহুরূপী এলেই পাড়ার শিশু, কিশোরদের মধ্যে একটা সাড়া পড়ে যেত। কোথাও দলে দলে মানুষ বেড়িয়ে আসতেন বহুরূপীদের দেখতে। তাঁর স্মৃতিচারণা থেকেই জানা যায়, সেই সময়ের বেশ কিছু বহুরূপী চার্লি চ্যাপলিনের পোশাক পড়ে তাঁকে নকল করত। রাধাপ্রসাদ গুপ্তের কথায়, ‘‘অবিশ্বাস্য হলেও তাঁরা চ্যাপলিনের মতো অবিকল হর্ষ, বিষাদ এবং মজার অঙ্গভঙ্গি নিয়ে সেই সময় কলকাতার সান্ধ্য পরিবেশ মাতিয়ে তুলতেন।’’
বীরভূম, বর্ধমান, হুগলি, মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ার বহু গ্রামে একটা সময় বহুরূপীদের রমরমা ছিল। এখন অবশ্য এই এলাকায় বহুরূপী শিল্পের কদর কমেছে। তবে বৈঁচি, তারকেশ্বর, চুঁচুড়া এবং বীরভূম জেলার লাভপুরের কাছে কয়েক জন কোনও রকমে টিকিয়ে রেখেছেন শিল্পটিকে। এই এলাকায় এখনও রয়েছেন রাজু চৌধুরী, ছিদাম চৌধুরী, সুবল দাস বৈরাগ্যের মতো শিল্পীরা। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক প্রজন্ম ধরে তাঁরা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তবে শিল্পী রাজু রায়চৌধুরী জানান, বর্তমানে এই শিল্পের প্রতি তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ কমছে। কেন? এই প্রশ্ন করলে শিল্পী সুবল দাস বৈরাগ্য, রাজু রায়চৌধুরীরা জানান, বিনোদনের নিত্যনতুন মাধ্যম আবিষ্কারের ফলে আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে এই শিল্পমাধ্যম। শিল্পীরা জানান, আগে শিব থেকে শুরু করে নর্তকী, বাইজি, এমনকি সমকালীন নানা চরিত্র সেজেও দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন। কিন্তু বর্তমানে ধীরে ধীরে শিল্পের জনপ্রিয়তা কমায়, নানা রূপে সেজে পথে পথে ঘুরেও পেট ভরে না। তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে তৈরি হওয়া অনীহা এই শিল্পের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিচ্ছে।
তবুও অভাব ও দু’মুঠো ভাতের টানে ওঁরা সকাল থেকে রং মেখে শিব-দুর্গা, বাউল, লালন ফকির, ডাকাত সর্দার কিংবা পাগল সেজে বেড়িয়ে পড়েন। কিন্তু আর কত দিন এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে তা নিয়ে তাঁরা নিজেরাও সন্দিহান। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ছৌ, বাউল, ঝুমুরের মতো মাধ্যমের শিল্পীরা বিভিন্ন সরকারি সচেতনতামূলক শিবিরে ডাক পান। সেই কাজে যদি তাঁদের আরও বেশি করে শামিল করা যায় তা হলে হয়তো সুদিন ফিরবে। ছৌ শিল্পের মতো মাধ্যমকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে সরকার যে চেষ্টা করছেন তার কিছুটা যদি তাঁদের শিল্পের জন্য করা হয় তা হলে উপকার হবে বলে আশা শিল্পীদের।
পঞ্চপল্লি এমসি হাইস্কুলের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy