সংস্কারের কাজ চলছে অজয় সেতুতে। ইলামবাজারে তোলা নিজস্ব চিত্র।
প্রাচীন নির্মাণ পদ্ধতি। সঙ্গে প্রতি দিন সাধ্যাতীত ভাবে ভারী যানের চলাচল। এমনকী, সেতুর নীচের বড় অংশ থেকে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বালি উত্তোলন। সব কিছু মিলেই বীরভূম ও বর্ধমান— এই দুই জেলার সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ সেতুটির হাল ক্রমশই বিপজ্জনক দিতে এগিয়েছে।
এমনটাই মতামত ইলামবাজারে অজয় সেতুর সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত ইঞ্জিনয়ারদের একাংশের। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে নির্ধারিত দিনেই সেতু খুলে দেওয়াটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের কাছে। তবে, প্রথম বার নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলেও এ বারও যাতে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তৎপরতা শুরু করেছে পূর্ত দফতর (সড়ক)।
সে দিকে ইঙ্গিত করেই সংস্কারের জন্য দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা অজয় সেতু নির্ধারিত দিনেই খুলে যাবে বলে আশ্বাস দিচ্ছেন দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অশোক কুমার। এমনটা হলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন বীরভূম ও বর্ধমানের ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ— প্রতিনিয়ত ওই সেতুর উপর নির্ভর করে যাঁদের জীবনযাপন।
এমন আশার কথা শোনার পরেও একটি প্রশ্ন ভাবিয়ে তুলেছে দুই জেলার মানুষকে। এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপন্ন ওই সেতু সংস্কারের পরেও কি আর আগের অবস্থায় ফিরবে? ইতিবাচক উত্তর মেলেনি অন্তত দফতর এবং সংস্কারের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার সংস্থার ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলে। নামপ্রকাশ না করার শর্তে প্রত্যেকেই মেনে নিয়েছেন, এখন থেকে অজয় সেতুতে ভারী ও অতিরিক্ত পণ্যবাহী যান চলাচল নিয়ন্ত্রিত না হলে অচিরেই ফের একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তেমন আশঙ্কা করেই এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই ভাবনা-চিন্তা শুরু হয়েছে প্রশাসনের অন্দরে। সংস্কারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার এক উচ্চ পদস্থ আধিকারিক আবার বলছেন, ‘‘আপাতত যান চলাচলের জন্য যেটুকু না করলেই চলছিল না, সেটুকু সংস্কারের জন্যই আমাদের বরাত দেওয়া হয়েছিল। সেই কাজ এখন শেষের দিকে। কিন্তু সেতুটির সম্পূর্ণ মেরামতির জন্য অনেক বেশি সময় দাবি করে। বর্ষার এই মরসুমে সে কাজ করা সম্ভবও নয়।’’ পূর্ত দফতরের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন— মূলত দু’টি কারণে সেতুর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এক, সেতুর গঠনশৈলী। দুই, পাঁচ দশকেরও পুরনো ওই সেতুর উপর দৈনিক হাজার হাজার ভারী যানবাহনের যাতায়াত।
দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা জানান, ১৯৬২ সালের ১৭ জুন ১৪ নম্বর রাজ্য সড়কে অজয় নদের উপরে ইলামবাজারে বর্ধমান-বীরভূম সংযোগকারী এই সেতুর উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। বীরভূম-সহ আশপাশের কিছু জেলা এবং একাধিক রাজ্যের সঙ্গে কলকাতার অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম এই সেতু। কিন্তু সমস্যা হল, গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি যে প্রযুক্তিতে তৈরি (ক্যান্টিলিভার ব্যালান্স ব্রিজ) গোটা দেশে মাত্র দু’টি এমন সেতু রয়েছে। অজয় ছাড়া অনুরূপ আর একটি সেতু রয়েছে কেরলে। এই ধরনের সেতুতে গাড়ি চলাচল করলে শুধু গাড়িটির অবস্থানের আগে এবং পিছনের পিলারেই ভার বণ্টিত হয় না, সেতুর সব ক’টি পিলারের পাশাপাশি এবং উপর-নীচেও ভার ছড়িয়ে পড়ে।
২০০৬ সালে পানাগড়-মোরগ্রাম সড়কের দুবরাজপুর থেকে মোরগ্রাম পর্যন্ত অংশটি ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে পরিবর্তিত হওয়ার পরে এবং পানাগড়-মোরগ্রাম সড়কের দুবরাজপুর পর্যন্ত অংশ ১৪ নম্বর রাজ্য সড়ক হওয়ার পরেও যানবাহনের চাপ কমেনি। বরং দ্বিগুন হয়েছে। ভেদিয়া হয়ে বা পাণ্ডবেশ্বরের কাছে অজয় সেতু দিয়ে বীরভূমের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা সম্ভব হলেও এই সেতুর গুরুত্ব অনেকটাই। সামরিক দিক থেকেও। দফতের ইঞ্জিনিয়ররাই বলছেন, ‘‘সেতু মেরামতের কারণে যান চলাচল বন্ধ থাকায় পানাগড় থেকে অসম যাওয়ার পথে একটি বিশাল আকৃতির সেনাবাহিনীর ট্রেলার দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেননা সেটি অন্য কোনও রাস্তায় যেতে পারবে না।’’ অথচ সেতুটি একই রকম থেকে গিয়েছে। দীর্ঘকাল সংস্কার হয়নি। তার উপর দিয়েই ভারী ট্রলার, ভারী যানবাহনের যাতায়াত যেমন বেড়েছে, তেমনই বেড়েছে প্রতিদিন শ’য়ে শ’য়ে অতিরিক্ত বালি বা পাথর নিয়ে দশ চাকা ট্রাক ও ডাম্পারের যাতায়াত। তার দোসর হয়েছে নদী থেকে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বালি তোলা। সব মিলিয়েই ক্রমশ দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে সেতু। অভিযোগ, সব কিছু জেনেও দিনের পর দিন ক্ষমতার বাইরে ওই সেতু দিয়ে হাজারও পণ্যবাহী গাড়ি যাতায়াত করতে দেওয়া হয়েছে। গত বছর কয়েকটি পিলারে হঠাৎ ফাটল দেখা যায়। তখন মাসখানেক বন্ধ রেখে সেতু মেরামত করা হলেও বিশেষ কিছু লাভ হয়নি।
দফতর সূত্রের খবর, ‘ক্যান্টিলিভার ব্যালান্স’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেতুটি তৈরি করেছিল যে সংস্থা, বর্তমানে তার অস্তিত্বই নেই। এই কাজে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার পাওয়াও এখন সমস্যার। শেষমেশ বিপন্ন ওই সেতু মেরামতের দায়িত্ব দেওয়া হয় ভীমগড় ও বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বর মধ্যে অজয়ের উপর সেতু গড়ার দায়িত্বে থাকা সংস্থাকেই। কিন্তু কাজ শুরু হতেই ইঞ্জিনিয়ারেরা দেখেন— যে ক্ষতি আন্দাজ করে কাজে হাত দেওয়া হয়েছে, ক্ষতির পরিমাণ তার থেকে অনেক বেশি। ফলে নির্ধারিত সময়েও প্রথম বার কাজ শেষ করা যায়নি। তার জেরেই গত ৩-২৯ জুন পর্যন্ত সংস্কারের জন্য নির্দিষ্ট থাকলেও শেষ পর্যন্ত সংস্কারের মেয়াদ ২০ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ফলে অজয় সেতুর উপর দিয়ে চলাচল বন্ধ রাখায় প্রচণ্ড সমস্যা বেড়েছে। বিকল্প রাস্তা ও সেতুতে যানজট, দুর্ভোগও অব্যাহত।
এই পরিস্থিতিতে সমাধান একটাই— বিকল্প সেতু তৈরি করা। পূর্ত দফতরের (সড়ক) এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার অশোক কুমারও বলছেন, ‘‘অতিরিক্ত যান চলাচলের জন্যই সেতুটি এমন বেহাল হয়েছে। তবে বিকল্প সেতুর গড়ার প্রক্রিয়া চলছে। সমীক্ষাও হয়েছে। ইতিমধ্যেই মাটি পরীক্ষার জন্য দরপত্র ডাকা হয়েছে। কিন্তু যতদিন না সেটি তৈরি হচ্ছে, দুর্ভোগ চলবেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy