কামরুজ্জামান সরকার। নিজস্ব চিত্র
প্রথম দিকে মাসে একটা, দুটো হামলার ঘটনা। শেষে তিনটি করে হামলা, খুনের ঘটনা প্রতি মাসে। পুলিশ বলছে, ‘খুনের নেশা’ চেপে গিয়েছিল আততায়ীর।
বেশির ভাগ ঘটনাতেই আক্রমণের সঙ্গে কিছু জিনিস চুরির অভিযোগ মিলেছিল। যে কয়েকজন বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁদের বয়ান নেয়, ছবি আঁকায় পুলিশ। ধরা পড়ার ভয়ে খুনের হাতিয়ার, ধরন বদলে ফেলেছিল আততায়ী। তার পরেও পুলিশ তার নাগাল পায়নি। সাহস বাড়ার সঙ্গে খুনের নেশাটাও বেড়ে গিয়েছিল ‘সিরিয়াল কিলারে’র।
এ বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি হুগলির বলাগড়ে যে পোশাকে, যে ভাবে খুন করতে গিয়েছিল আততায়ী, সেই পোশাকেই রবিবার কালনার সাধপুকুর এলাকায় দেখা যায় তাকে। বলাগড় পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সিসিটিভি ফুটেজের সেই ছবি তত দিনে কালনা মহকুমার সব থানা, সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিশদের চেনা। হুবহু মিলেই ধরা পড়ে যায় খুন, খুনের চেষ্টা-সহ ১৮টি হামলায় অভিযুক্ত ওই আততাতী কামরুজ্জামান সরকার।
পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, “ঘটনার পরম্পরা ও ধৃতের কথাবার্তা শুনে আমাদের ধারণা, চুরি করার উদ্দেশে নয়, মূলত খুন করার নেশা চেপে বসেছিল তার মধ্যে। ওই নেশা চাপলেই কোথায় একা মহিলা রয়েছেন, সে খোঁজ নিতে শুরু করত। তারপর মিটার দেখা বা অন্য অজুহাতে বাড়িতে ঢুকে সুযোগ পেতেই হামলা চালাত।’’ পুলিশের দাবি, কালনায় ১০টি, মেমারিতে ৫টি এবং হুগলির পাণ্ডুয়া এবং বলাগড়ে ৩টি জায়গায় অঘটন ঘটিয়েছে ধৃত। তার মধ্যে সাত জন মহিলা মারা গিয়েছেন। দুষ্কর্মে ধৃতের সঙ্গে অন্য কেউ থাকত না বলেও জেনেছে পুলিশ। সোমবার ধৃতকে কালনা এসিজেএম আদালতে তোলা হলে ১২ দিনের পুলিশ হেফাজত হয়। পুলিশ সুপারের দাবি, আরও প্রমাণ জোগাড় করে উপযুক্ত তথ্য দিয়ে দ্রুত চার্জশিট আদালতে জমা দেওয়া হবে।
এ দিন ধৃতের বাড়ি থেকে বেশ কিছু সোনার গয়না পুলিশ উদ্ধার করেছে। মিলেছে প্রচুর নকল গয়না। একটি সাধারণ ক্যামেরা ও কয়েকটি মোবাইল উদ্ধার করেছে পুলিশ। জেলা পুলিশের অনুমান, প্রণয় ঘটিত সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই ধৃতের মাথায় খুনের নেশা চেপেছে। তবে এ ব্যাপারে পুলিশ এখনও নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারছে না। পুলিশের দাবি, জিজ্ঞাসাবাদে ধৃত জানিয়েছে, অন্তত তিনটে ঘটনায় বাড়ির লোক তাঁকে ধরে ফেলেছিল। শেষ মূহুর্তে সে পালিয়ে আসে। পুলিশ জেনেছে, রবিবারও মেমারি এলাকায় খুনের ছক কষে যাচ্ছিল আততায়ী। মাঝপথে বৃষ্টি নামায় পরিকল্পনা বাতিল করে ফিরে আসে সে। লাল বাইকে ঝোলানো নাইলনের ব্যাগে মেলা শাবল, লোহার চেন তারই প্রমাণ।
পুলিশ জানিয়েছে, ছ’বছর আগে কালনা ও মন্তেশ্বরে দুটি খুন ও একটি খুনের চেষ্টার ঘটনার কথাও স্বীকার করেছে কামরুজ্জামান। তার দাবি, মুর্শিদাবাদ থেকে এসে ওই ঘটনা ঘটিয়েছিল সে। হামলার আগে ধৃত রীতিমতো এলাকা ‘রেইকি’ করত। মুর্শিদাবাদে তার নামে একাধিক চুরির অভিযোগ রয়েছে বলেও জানা গিয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, গত অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত অন্তত তিন বার খুন করার ধরন পাল্টেছে ধৃত। প্রথমে সে লোহার চেন গলায় পেঁচিয়ে খুনের চেষ্টা করত। কয়েক বার ব্যর্থ হওয়ার পর মাথায় শাবল, লোহার রড জাতীয় ভারী জিনিস দিয়ে আঘাত করত। তার পরে খুন নিশ্চিত করতে চেন দিয়ে শ্বাসরোধ করত। পুলিশের দাবি, ধৃত জেরায় মেনেছে লোহার শক্ত চেন গলায় পেঁচিয়ে দু’হাত দিয়ে টানতে অসুবিধা হত। তাই সে চেনের দুই প্রান্তে লাগিয়েছিল রবারের টিউব। খুন করার পরে নিহত মহিলাকে যৌন নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, খুন করার পরে কোথাও সে যৌনাঙ্গে টিভির রিমোট, কোথাও বেলনা, কোথাও লোহার রড ঢুকিয়ে দিত। হিংস্রতা বেড়ে গিয়েছিল, জানাচ্ছে পুলিশ।
তবে এত ঘটনাতেও সূত্র পেতে মুশকিলে পড়ে পুলিশ। এতগুলো জায়গা জুড়ে ঘটনা, আততায়ীর কাছে কোনও মোবাইল না থাকায় ‘টাওয়ার লোকেশন’ বা অন্য কোনও সূত্র ধরে তদন্ত এগোচ্ছিল না। বারবার হামলার ধরন বদলানোয় একই ব্যক্তি কি না, সে প্রশ্নও ওঠে। কালনার এসডিপিও শান্তনু চৌধুরী জানান, সিসিটিভি ফুটেজ আগেও পেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু বলাগড় থেকে পাওয়া ফুটেজ তদন্তে জট কাটাতে সাহায্য করে। কালনার সমস্ত থানা, পঞ্চায়েত এলাকার দশ জন করে সিভিক ভলান্টিয়ার, ভিলেজ পুলিশদের নিয়ে বৈঠক করে সবাইকে সেই ছবি, তথ্য দেওয়া হয়। যে সিভিক ভলান্টিয়ার ধরেছেন কামরুজ্জামানকে তিনিও জানিয়েছেন, ছবির সঙ্গে বাইক, হেলমেট, জুতো, পোশাকের ধরন হুবহু মিলে যাওয়ায় ‘চেন কিলার’কে বাগে পেতে সুবিধে হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy