Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

কাছাধারী গোপীনাথ দেখতে পথহারা বহু

প্রথম দিনের চিঁড়ে উৎসবের ভিড় তখনও জমেনি, অথচ দীর্ঘ হয়ে উঠেছে নিখোঁজ নামের তালিকা। বর্ধমানের অগ্রদ্বীপের মেলার প্রথম দিনের মেজাজটা ছিল এমনই। সোমবার দুপুরে গোপীনাথ মন্দির চত্বরের অনুসন্ধান-স্টল, কিংবা কিছুটা দূরে মেলা কমিটির দফতরের মাইকে কান পাতলেই ভেসে আসছিল-- অমিত রায়, অসীম দাস, রামকুমার সাহা, সঙ্গীতা রায়, কৃষ্ণনগর, ত্রিবেণী, চাকদা, ফরাক্কা, কর্ণসুবর্ণ....।

ভাগীরথী পেরিয়ে গোপীনাথের মেলায় মানুষের ঢল।ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভাগীরথী পেরিয়ে গোপীনাথের মেলায় মানুষের ঢল।ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

সৌমেন দত্ত
কাটোয়া শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৫ ০১:১২
Share: Save:

প্রথম দিনের চিঁড়ে উৎসবের ভিড় তখনও জমেনি, অথচ দীর্ঘ হয়ে উঠেছে নিখোঁজ নামের তালিকা।

বর্ধমানের অগ্রদ্বীপের মেলার প্রথম দিনের মেজাজটা ছিল এমনই। সোমবার দুপুরে গোপীনাথ মন্দির চত্বরের অনুসন্ধান-স্টল, কিংবা কিছুটা দূরে মেলা কমিটির দফতরের মাইকে কান পাতলেই ভেসে আসছিল-- অমিত রায়, অসীম দাস, রামকুমার সাহা, সঙ্গীতা রায়, কৃষ্ণনগর, ত্রিবেণী, চাকদা, ফরাক্কা, কর্ণসুবর্ণ....। মেলার হাজারো আওয়াজে বারবার মিশে যাচ্ছিল নানা চেনা-অচেনা জায়গার নানা নাম।

ফি বছর দোল সংক্রান্তির পরের একাদশীতে এই মেলা বসে। তিন দিনের মেলায় প্রথম দিন চিঁড়ে মহোৎসব, দ্বিতীয় দিন অন্ন মহোৎসব ও শেষ দিন বারুণী সংক্রান্তিতে স্নান। গোপীনাথের এই মেলা স্থানীয় ভাবে গোবিন্দঘোষ ঠাকুরের মেলা নামেও পরিচিত। শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ ছিলেন এই গোবিন্দ ঘোষ। কথিত রয়েছে, রাঢ় বঙ্গ ভ্রমণের সময়ে অগ্রদ্বীপে বিশ্রাম নিয়েছিলেন চৈতন্যদেব। সেই সময় গোবিন্দ ঘোষের সঞ্চয়ের প্রবণতা দেখে চৈতন্যদেব তাঁকে সংসারে মনোযোগী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শ্রীচৈতন্যর উপস্থিতিতে অগ্রদ্বীপ গ্রামে গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়। গোপীনাথের সেবা করার দায়িত্ব পান গোবিন্দ ঘোষ। কিন্তু তাঁর পাঁচ বছরের শিশু সন্তান মারা যাওয়ার পর সমস্ত ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপ থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন গোবিন্দ ঘোষ। শোনা যায়, তখন গোপীনাথ তাঁকে স্বপ্নে বলেন, তোমার মৃত্যুর পর আমি পুত্র হয়ে পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম করব। এবং গোবিন্দ ঘোষের মৃত্যুর পরে গোপীনাথ কাছা পড়ে পারলৌকিক কাজ করেন বলেও কথিত রয়েছে। সেই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ঘিরেই ভাগীরথীপ পশ্চিম পাড়ে বসে এই মেলা।

এ দিনও রাজ্যের অন্যতম বড় এ মেলার নায়ক গোপীনাথ পুরোহিতদের কোলে চড়ে সমাধিস্থলে যেতেই গুঁতোগুঁতি শুরু হয়ে যায়। শুরু হয় ভিড়ে ছিটকে হারিয়ে যাওয়ার পালাও। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের গ্রাম থেকে নাতিকে নিয়ে মেলায় এসেছিলেন মধ্যবয়সী এক মহিলা। ভিড়ের চাপে কখন যেন হাত ফসকে গিয়েছে নাতির। পুঁটলি আঁকড়ে আর্তনাদ করতে করতে নাম লেখানোর নিখোঁজ-লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন প্রৌঢ়া। ভাগীরথীর অন্যপাড়ে, কাটোয়া ২ ব্লক প্রশাসনের তাবুতে বসে বিডিও শিবাশিস সরকার বলেন, “ভিড় জমার আগেই হারিয়ে যাওয়ার ভিড় বাড়ছে। মঙ্গল, বুধবার কী হবে ভেবেই শিউরে উঠছি!”


অগ্রদ্বীপ ফেরিঘাটে পাড় ভাঙছে নদী। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়।

অন্যান্য বছর দুর্গাপুজোর পরে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি থেকে গোপীনাথ অগ্রদ্বীপ গ্রামে আসতেন। মেলা শেষ হওয়ার পর ফের রাজবাড়িতে ফিরে যেতেন। এটাই ছিল আনুমানিক চারশো বছরের প্রথা। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দাবি, গোপীনাথ তাঁদের কুলদেবতা। আর অন্যদিকে অগ্রদ্বীপ গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, গোপীনাথ অগ্রদ্বীপের ভূমিপুত্র। কিন্তু গত বছর থেকে সেই দাবিতেই অগ্রদ্বীপের বাসিন্দারা ‘ভূমিপুত্র’কে ছাড়েননি। ভূমিপুত্র ও কুলদেবতার ‘লড়াই’ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তবে এই টানাটানির প্রভাব অবশ্য মেলায় পড়েনি। গোপীনাথ এখন বছরভর অগ্রদ্বীপেই পূজিত হন। মেলা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জহর দে বলেন, “গোপীনাথ শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর বা অগ্রদ্বীপের নয়, এখন সবার।” অন্যান্য বারের মত এ বারেও আখড়া নিয়ে হাজির হয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। তিনি সকালেই ধুতি-পাঞ্জাবি পড়ে গোপীনাথ মন্দিরে পুজো দেন। দুপুরে এসে পুজো দিয়ে যান বর্ধমান পূর্বের তৃণমূল সাংসদ সুনীল মণ্ডল।

অগ্রদ্বীপ স্টেশন থেকে ফেরিঘাটের দূরত্ব মেরেকেটে চার কিলোমিটার। সেখান থেকে ভাগীরথী পেরিয়ে অগ্রদ্বীপ গ্রাম। এ বার সুন্দর ভাবে ফেরিঘাট পরিচালনা করছেন স্বয়ং বিডিও। বাঁশের ব্যারিকেড দিয়ে ভাগীরথীর পাড় ঘিরে পাঁচটি ফেরিঘাট দিয়ে অনবরত নৌকা চলাচল করছে। ফেরিঘাটে যথেষ্ট পরিমানে আলোর ব্যবস্থাও করেছে প্রশাসন। তবে সব দিক অবশ্য এমন নয়। মেলার চারিদিকে চোখে পড়ে স্বচ্ছ ভারত আর নির্মল বাংলার পোস্টার, ফ্লেক্স সাঁটা। কিন্তু অগ্রদ্বীপকে মেলার ক’দিন নির্মল রাখার কোনও ব্যবস্থা যে করা হয়নি তা ভাগীরথী পাড় থেকে মেলা প্রাঙ্গনে যাওয়ার রাস্তাতেই মালুম হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

fair gopinath katoya soumen dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy