Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
কমিশনের নজরে

চিন্তা বাড়াচ্ছে ফুটিসাঁকো

বর্ধমানের কেতুগ্রামের এই ফুটিসাঁকো মোড় আসলে বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ— এই তিন জেলার সংযোগস্থল। যার উত্তর-দক্ষিণে চলে গিয়েছে বাদশাহী রোড, পশ্চিমে কীর্নাহার রোড ও পূর্বে কাটোয়া রোড।

তিন জেলার সংযোগস্থল ফুটিসাঁকো। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

তিন জেলার সংযোগস্থল ফুটিসাঁকো। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৬ ০২:০৭
Share: Save:

চার মাথার মোড়ে রয়েছে একটি বটগাছ। দিনভর সেই গাছের ছায়া পায় তিনটি জেলা।

বর্ধমানের কেতুগ্রামের এই ফুটিসাঁকো মোড় আসলে বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ— এই তিন জেলার সংযোগস্থল। যার উত্তর-দক্ষিণে চলে গিয়েছে বাদশাহী রোড, পশ্চিমে কীর্নাহার রোড ও পূর্বে কাটোয়া রোড। এই মোড়কে কেন্দ্র করে একটি বৃত্ত আঁকলে ৬ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে পাওয়া যাবে তিন জেলার চারটি থানা এলাকা।

হলদিয়া-ফরাক্কা বাদশাহী রোড ধরে বর্ধমানের নতুনহাটের অজয় সেতু পেরোনোর পরে পশ্চিমে বীরভূমের নানুর, পূর্বে বর্ধমানের কেতুগ্রাম। কয়েক কিলোমিটার দূরে পড়ে কেতুগ্রামের ফুটিসাঁকো মোড়। যেখান থেকে বেরোচ্ছে কীর্ণাহার ও কেতুগ্রামে যাওয়ার রাস্তা। এই ফুটিসাঁকো মোড়কে ঘিরে রয়েছে চারটি থানা—বীরভূমের লাভপুর ও নানুর, বর্ধমানের কেতুগ্রাম ও মুর্শিদাবাদের বড়ঞা। ফুটিসাঁকো থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে রয়েছে মারুট মোড়। সেই মোড়ও তিন জেলার সংযোগস্থল। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সেখানে একটি টিউবওয়েল রয়েছে। যেটির অবস্থান বর্ধমানে, হাতলটি রয়েছে বীরভূমে আর জল পড়ে মুর্শিদাবাদে। মারুটকে ঘিরে রয়েছে কেতুগ্রাম, লাভপুর ও বড়ঞা থানা এলাকা।

ভোটের আগে এই দু’টি মোড় নিয়ে নড়েচড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন। মঙ্গলবার কলকাতার বৈঠকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন ও পুলিশ সুপার কুণাল অগ্রবালকে ফুটিসাঁকোর উপরে নজর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিন জেলার এই সংযোগস্থল নিয়ন্ত্রণে রাখা ‘মেজর চ্যালেঞ্জ’ বলেও উল্লেখ করেছে কমিশন। প্রশাসনের কর্তারা জানান, এই দু’টি মোড় দিয়ে দুষ্কৃতীরা অবাধে যাতায়াত করে। বর্ধমান ও বীরভূম জেলায় কাজ করা এক পুলিশ কর্তা বলেন, “ফুটিসাঁকোকে ঘিরে তিন জেলার গ্রামের মধ্যে কোনও সীমানা নেই। বাড়িগুলিও লাগোয়া। ফলে, এক জেলায় দুষ্কর্ম করে সহজেই অন্য জেলায় ঢুকে পড়া যায়। তা ছাড়া অনুপ্রবেশও ঘটে। সে জন্য দুষ্কৃতীদের ধরা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।”

ফুটিসাঁকোকে ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ শ্যাডো জোন’ বলে চিহ্নিত করেছে প্রশাসন। মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের বৈঠকের পরে মারুট মোড়কেও ‘শ্যাডো জোন’ ধরে এগোতে চাইছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার ফুটিসাঁকো মোড়ে বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ প্রশাসন প্রায় ৪০ মিনিট ধরে আলোচনা করে। সেখানে ঠিক হয়, ফুটিসাঁকোয় ৬টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হবে। যার মধ্যে তিনটি থাকবে বীরভূম, একটি মুর্শিদাবাদ ও দু’টি বর্ধমানের দিকে মুখ করে। বুধবার দুপুরের পরে ঠিক হয়েছে, মারুট মোড়েও প্রয়োজন মতো সিসি ক্যামেরা বসানো হবে। এ ব্যাপারে এক অতিরিক্ত জেলাশাসককে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি কান্দির অপহৃত কাউন্সিলরকে উদ্ধার করা হয় বাদশাহী সড়কের উপরে বর্ধমান-মুর্শিদাবাদের সীমানায় কুঁয়ে নদীর সেতু থেকে। তেমনই ২০১০ সালের মুর্শিদাবাদের এক সিটু নেতার দেহ মিলেছিল এই এলাকা থেকেই। ২০১৪ সালের ৫ অগস্ট খুন হন কেতুগ্রামের কাঁটারি গ্রামের আসমিরা খাতুন। ওই খুনে অভিযুক্তেরা বীরভূমের সীমানার গ্রামে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত তুফান শেখকে পুলিশ গ্রেফতার করে বাদশাহী রোডের উপর রতনপুর পীরতলা থেকে। ২০০৬ সালে রেশন কাণ্ডে কেতুগ্রামের সেরান্দি গ্রামে এক ব্যক্তি পুলিশের গুলিতে নিহত হন বলে অভিযোগ। ওই গ্রামের একটি গলি জেলার সীমানা। কেতুগ্রাম থানার প্রাক্তন পুলিশ অফিসার বলেন, “২০০৭ সালে কেতুগ্রামে একের পর এক গ্রামে প্রতি দিন লুঠপাট হত। আমরা সব জেনেও কিছুই করতে পারছিলাম না। ওই সব দুষ্কৃতীরা স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে হেঁটে যাতায়াত করত।” বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ, আমলা হিসেবে তিন জেলাতেই কাজ করা এক আধিকারিক বলেন, “অপরাধীরা ফুটিসাঁকো অঞ্চলকে ‘স্ট্র্যাটেজিক জোন’ হিসেবে ব্যবহার করে। পিচ রাস্তা ধরে মোটরবাইক নিয়ে ৫-৬ কিলোমিটারের মধ্যে অন্য জেলায় সহজেই ঢুকে পড়া যায়।”

খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের পরেও গোয়েন্দাদের নজরে ধরা পড়ে এই ফুটিসাঁকো মোড়। জাল ছড়াতে এই এলাকাকে জঙ্গিরা কাজে লাগিয়েছিল বলে এনআইএ-র এক কর্তার দাবি। তিনি বলেন, “জঙ্গিরা বীরভূম ও বর্ধমানের মধ্যে যে মোটরবাইক নিয়ে যাতায়াত করত, সে ব্যাপারে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। ফুটিসাঁকো মোড় ব্যবহার করে জঙ্গিরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নদিয়া পৌঁছে যেত।” ফুটিসাঁকো থেকে কিলোমিটার চারেকের মধ্যে বীরভূমের নিমড়ে গ্রাম, যেখানকার কয়েক জনের জঙ্গি-যোগ পেয়েছিলেন গোয়েন্দারা।

এই ‘শ্যাডো জোন’কে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তিন জেলা প্রশাসন এক হয়ে সিসি ক্যামেরা বসিয়েছে। তাতে কাজ কতটা হবে? স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, মোটরবাইকের উৎপাত কমেছে ঠিকই। কিন্তু গ্রামের ভিতর দিয়ে সরু গলি বা খেত জমির আলপথ দিয়ে হাঁটাচলা বেড়েছে। হেঁটে বা সাইকেলে করে অচেনা লোকজনকে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “সিসি ক্যামেরা বসানোর পর থেকে গ্রামের গলি ধরে মাঝরাতে মোটরবাইক চলাচল করছে।”

সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিকের বক্তব্য, “আমরা ওই এলাকায় দুষ্কৃতীদের অবাধ বিচরণ নিয়ে অভিযোগ করেছি। আমরা মনে করি, শুধু সিসি ক্যামেরা বসালেই দুষ্কতীদের যাতায়াত বা অপরাধ কমানো সম্ভব হবে না। ওই এলাকায় অবাধ নির্বাচন করতে গেলে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারে নামতে হবে পুলিশকে।” এক সময়ে এই সব জেলায় কাজ করা পুলিশ ও প্রশাসনের দুই কর্তার মতে, তিন জেলার মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে। ব্লক প্রশাসন ও স্থানীয় থানার অফিসারদের মধ্যে বারবার আলোচনা করে ও যৌথ অভিযানে নামলে এই ধরনের শ্যাডো জোনে দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত বন্ধ করা সম্ভব হবে।

বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বলেন, “সিসিটিভির পাশাপাশি নাকাবন্দি ও টহলদারি চলছে। তিন জেলা যৌথ ভাবে তল্লাশি চালাচ্ছে। আচমকা হানা দিয়ে গাড়ি পরীক্ষাও করা হচ্ছে। এ ছাড়া আইবি এলাকায় ঘুরে খবর সংগ্রহ করে আমাদের দিচ্ছে। সেই মতো আমরা ব্যবস্থাও নিচ্ছি।”

অন্য বিষয়গুলি:

futisanko election commission vote administration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy