Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

সোনা জিতেছে ছেলে, কপালে ভাঁজ বাবার

সাড়ে তিন বছর বয়স থেকেই রোজ বিকেলে দাদুর সঙ্গে বেরিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে খেলা অভ্যাস ছিল তার। বাড়িতেও শান্ত হয়ে থাকত না কোনও সময়েই। এ সব দেখে, সঙ্গে নাতির সুরক্ষার জন্য একটি ক্যারাটে প্রশিক্ষণ সংস্থায় ভর্তি করান দাদু।

অনুশীলনে ব্যস্ত অনিকেত। —নিজস্ব চিত্র।

অনুশীলনে ব্যস্ত অনিকেত। —নিজস্ব চিত্র।

সুচন্দ্রা দে
কাটোয়া শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ০০:৫৫
Share: Save:

সাড়ে তিন বছর বয়স থেকেই রোজ বিকেলে দাদুর সঙ্গে বেরিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে খেলা অভ্যাস ছিল তার। বাড়িতেও শান্ত হয়ে থাকত না কোনও সময়েই। এ সব দেখে, সঙ্গে নাতির সুরক্ষার জন্য একটি ক্যারাটে প্রশিক্ষণ সংস্থায় ভর্তি করান দাদু। সেই ক্যারাটের হাত ধরেই দেশের পতাকা ধরে বিদেশে পা রাখবে সোনাজয়ী অনিকেত চট্টোপাধ্যায়।

কাটোয়ার সুদপুরের বিজয়নগর গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র অনিকেত এখন ক্যারাটেতে জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক স্তরের চ্যাম্পিয়ন। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় আর্ন্তজাতিক টুর্নামেন্টে স্বর্ণপদক পেয়ে বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্র পেয়েছে ছিপছিপে এই খুদে। তবে সাফল্যের এই সফর মসৃণ ছিল না।

অনিতেকের বাবা, কম্পিউটার প্রশিক্ষক শুভময় চট্টোপাধ্যায় জানান, কাটোয়ার শোতোকান ক্যারাটে অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণের সময় থেকেই ক্যারাটের প্রতি নাতির তীব্র আকর্ষণ লক্ষ্য করেন দাদু বলাইগোপালবাবু। আরও ভাল ভাবে শেখাতে সীমিত সাধ্যের মধ্যেও কলকাতার কেষ্টপুর এলাকায় একটি ঘরভাড়া নিয়ে ওডোকাই ক্যারাটে অ্যাসোসিয়েশনে নাতিকে ভর্তি করান তিনি। পাশাপাশি সল্টলেকের একটি বেসরকারি স্কুলে চলে অনিকেতের পড়াশোনা। প্রশিক্ষণ চলাকালীন একাধিক জেলাভিত্তিক প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে প্রথম স্থান পায় অনিকেত। হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে সংসারে। বলাইগোপালবাবু মারা যাওয়ার পরে পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে টাকার অভাবে যে কোনও প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া বন্ধ হয়ে যায় অনিকেতের। শুভময়বাবু জানান, দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে বাড়িভাড়া দিতে না পারায় ওই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় একরত্তি ছেলেটার পড়াশোনা, ক্যারাটে প্রশিক্ষণ দুটোই। গ্রামে ফিরে আসেন সপরিবার শুভময়বাবু। কিছুদিন পর অবস্থা একটু শোধরালে মামাবাড়ির আর্থিক সহায়তায় আবার কলকাতায় থাকার লড়াই শুরু হয়। ছোট্ট ভাড়ার ঘরে দারিদ্রের সাথে লড়াই করে শুরু হয় ছোট্ট অনিকেতের স্বপ্নসফর। স্কুলের পড়ার পাশাপাশি দিনে চার ঘন্টা করে প্র্যাকটিস শুরু হয়ে যায়। সাত বছর বয়সে জাতীয় স্তরে খেলার প্রথম সুযোগ আসে। আত্মীয়দের কাছে চেয়ে-চিন্তে অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে খেলতে যায় অনিকেত। সেখানে দুটি প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক পেয়ে আর্ন্তজাতিক স্তরে খেলার ছাড়পত্র পায়। গুজরাটের বরোদা ও মহারাষ্ট্রের নানদেদেতে পরপর দুটি আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতার একটিতে সোনা, একটিতে রুপো জেতে কাটোয়ার ছেলে। ২০১৬-র মে মাসে সুযোগ আসে বিদেশ সফরের।

শুভময়বাবু জানান, জমি জায়গা বিক্রি করে জমা টাকা নিয়ে ছেলেকে নিয়ে শ্রীলঙ্কা পাড়ি দেন তিনি। সেখানে আর্ন্তজাতিক কবাডি প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়ে বাবার হাতে দুটি স্বর্ণপদক তুলে দেয় ছেলে। সম্প্রতি গ্যাংটকে আয়োজিত ১৯তম সর্বভারতীয় ওডোকাই ক্যারাটে চ্যাম্পিয়ন হয়েও সোনা ও রুপো জিতেছে সে। ২০১৮-র বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্রও পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু ছেলের এত সাফল্যেও কপালে ভাঁজ বাবার। আশঙ্কা একটাই, টাকার অভাবে থেমে যাবে না তো ছেলের লড়াই?

ছেলের জেতা পদক হাতে নিয়ে শুভময়বাবু বলেন, ‘‘জানি না এরপরে কী করে ওকে ক্যারাটে শেখাব! সামান্য রোজগারের টাকায় স্বপ্ন দেখাই যেন দায় আমাদের। তবে ছেলের যখন এটাই ধ্যান-জ্ঞান তখন যেভাবেই হোক ওকে অলিম্পিকে নিয়ে যাব।’’ মা অলকানন্দাদেবীও ছেলেকে পাশে নিয়ে বলেন, ‘‘ছোট থেকে ক্যারাটেই ওর সব। ওর স্বপ্নপূরণ করতেই হবে।’’ অনিকেতের প্রশিক্ষক রাজু শিকদারও জানান, অনিকেতের মতো প্রতিভা কম দেখা যায়। ওকে ২০২০-তে অলিম্পিকে নিয়ে যাওয়াই তাঁর লক্ষ্য। কাটোয়ার অন্যতম ক্রীড়াবিদ তথা ক্যারাটে প্রশিক্ষক রামকৃষ্ণ নাথের গর্বের শেষ নেই ছোট্ট ছাত্রটিকে নিয়ে। তিনি বলেন, ‘‘কাটোয়া এলেই আমার কাছে আসে। ও দেশের গর্ব।’’

ছোট্ট অনিকেতের অবশ্য প্রশংসায় কান নেই। সে শুধু বলে, ‘‘খুব খাটছি। সামনেই অলিম্পিকে যেতে হবে যে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

gold karate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy