বসন্তোত্সবে পঞ্চবটি থেকে নগর পরিক্রমা।
বর্ধমান শহর ছাড়িয়ে দামোদরের পাড়ে সবুজে ঘেরা নয় বিঘা জমি। পাখির ডাক ছাড়া শব্দ নেই। বর্ধমানের শশঙ্গার পঞ্চাননতলায় এমন পরিবেশে ‘পঞ্চবটী বসন্ত পার্বণে’ মেতে উঠলেন আশ্রমবাসী। দামোদরে চরের বালিতে ন্যাড়া পোড়ার পাশাপাশি সাঁওতালি নৃত্যের সঙ্গে উড়ল রঙিন ফানুস। নগর পরিক্রমা, রায়বেঁশে আর গান-মেলায় মেতে উঠল আশপাশের কয়েকটা গ্রাম। সেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেতে উঠলেন কলকাতা ও বিভিন্ন জেলার মানুষ, এমনকী বিদেশিরাও।
ফকির সাধন দরবেশ (সাধনদাস বৈরাগ্য) এবং মাকি কাজুমি-র আশ্রম। দোল উপলক্ষে সেই আশ্রমেই কয়েক দিন ধরে চলেছে উত্সব। আশ্রমেই অন্যদের সঙ্গে পাত পেড়ে খাওয়া। মুখে লেগে থাকা নিরামিষ খাবারের পাশাপাশি দামোদরের টাটকা মাছের ঝোল। গোটা অনুষ্ঠানের নাম, ‘বসন্ত বাউল, লোকগাথা’।
বস্তুত বাঙালির মন থেকে দোল বলতে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উত্সবের ধারণা ঘুচেছে গত কয়েক বছর ধরে। দোলে হাজার-হাজার মানুষের ভিড়ের সুযোগে সেখানকার হোটেলগুলিতে থাকা-খাওয়ার দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে নেওয়া, ঘর না মেলার মতো সমস্যা নিয়ে নানা অভিযোগও উঠছিল। তাই শান্তিনিকেতন বিমুখতা তৈরি হচ্ছিল। তারই বিকল্প হিসেবে বাঙালি যেন খঁুজে নিচ্ছে নতুন জায়গা।
কয়েক বছর ধরে জেলার জেলায় দোলে জোড়াসাঁকো, শান্তিনিকেতনের ধাঁচে শুরু হয়েছে প্রভাতফেরি, আবির খেলা, গান-বাজনা, নৃত্যানুষ্ঠান। যেমন হয়েছে পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, উত্তর দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায়। তিন দিন বা দু’দিনের প্যাকেজে কম খরচায় বাঙালি কাটিয়ে আসছে বসন্ত উত্সবের দিনগুলি। গত বছর থেকে দামোদর পাড়ে পঞ্চবটী আশ্রমেই তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। তাঁবুতেই থাকার ব্যবস্থা। উদ্যোক্তা রাজীব রায় বলেন, “এই অনুষ্ঠানে যাঁরা এক বার এসেছেন, তাঁরা বারবার আসতে চান, এটাই এই আশ্রমের বিশেষত্ব।”
আশ্রমে সাধনদাস বৈরাগ্য।
কেমন বিশেষত্ব? দোলের জন্য আবির আর নানা রঙা পতাকায় সুন্দর করে সাজানো হয় পঞ্চবটী। দোলের আগের দিন সকালে দেখা গেল, মূল মঞ্চে চলছে বাউল, লোকগীতি, বিভিন্ন গানের আসর। সন্ধ্যা নামতেই প্রচুর ঢাক, কাঁসর আর শাঁখের বাদ্যর সঙ্গে আগুন দেওয়া হয় চাঁচরে। অশুভ শক্তিকে বিনাশের আহ্বান জানানো হয়। দামোদরের অন্য পাশে চলতে থাকে মাদলের সঙ্গে সাঁওতালি নৃত্য। আলো বুকে নিয়ে একের পরে এক ফানুস উড়ে যায় আকাশ ফঁুড়ে।
ততক্ষণে মেলার মাঠে শুরু হয় আদিবাসীদের নৃত্য। বাজনার তালে তালে শরীরের নানা কসরত দেখায় অল্পবয়সী বালক থেকে বৃদ্ধ। রাত বাড়তে মূল মঞ্চে শুরু হয়ে যায় বাউল গানের আসর। অনন্ত দাস বাউল, ভজন দাস বৈরাগ্য, হালিম ফকির, স্বপন অধিকারী, কার্তিক দাস বাউল, সোনা খ্যাপার মতো প্রখ্যাত শিল্পীরা গান-বাজনায় বিভোর করে দেন।
এখানে দোল পূর্ণিমার সকালে রঙ্গোলিতে সাজানো হয় দোলমঞ্চের মানববেদী। সেখানে আবির খেলার পরে শুরু হয় নগর ঘোরা। আমরুল গ্রামে দামোদর পাড়ে বস্তায় আলু ভরছে চাষি। তাঁদের কপালে আবির মাখিয়ে দেন সাধনদাস বৈরাগ্য, মাকি কাজুমির পাশাপাশি শুভ্রামা, শ্রুতিমার মতো বিদেশিনিরা। বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েরা ছুটে এসে প্রণাম করেন তাঁদের। ন’পাড়া, নায়েব পাড়া, মাছিলা, বিহারি পাড়ার মতো গ্রামে ঢুকে ঢাক ও কাঁসরের বাজনার তালে চলে আবির খেলা। গ্রামের মোড়ে, কিংবা অশ্বত্থ তলায় গোল হয়ে প্রদর্শন হয়, প্রাদেশিক বিভিন্ন নৃত্য। বিদ্যুত্হীন, কাঁচা ধুলোয় ভরা ভাঙা রাস্তা, ভেঙে পড়া কুঁড়েঘর থেকে হত দরিদ্র মানুষগুলি মেতে ওঠেন বসন্তের সেই উত্সবে। তাঁদের মিস্টিমুখও করানো হয়।
আশ্রমে ফিরে মানববেদীতে ঢাক আর কাঁসরের নৃত্যের সঙ্গে নাচ-গান। এরপরেই আখড়া বাড়িতে শুরু হয় হরিনাম। তত ক্ষণে দামোদরে স্নান করতে নেমে পড়েছেন কেউ কেউ। এ দিক, কলকাতা থেকে সপার্ষদ চলে এসেছেন লোকশিল্পী অভিজিত্ বসু, এনাক্ষী ভট্টাচার্য বা পবনদাস বাউলের মতো শিল্পীরা। মূল মঞ্চে ফের শুরু হয়ে যায় গান। একের পরে এক শিল্পীর সেই গান চলতেই থাকে। দোল পেরিয়েও সেই অনুষ্ঠান চলে টানা কয়েক দিন। সেই অনুষ্ঠান ছেড়ে বাড়ি ফেরার সময় জয়দেবের কেঁদুলির বছর আটেকের ছোট্ট নন্দিনী পথ আগলে বলতেও পারে, “চইল্যে যাচ্ছো? না গ্যালে হবেক নাই?”
ছবি: সংহিতা দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy