পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন জমা দেওয়ার দু’দিন আগেও আসানসোল থেকে লড়তে বারণ করেছিলেন। গ্রাফিক—শৌভিক দেবনাথ।
বিজেপি-তে আমার পুরনো সহকর্মী ও ‘বন্ধুগণ’, আমার বুধবারের একটি মন্তব্যের বিরুদ্ধে এক হাস্যকর সমালোচনা লিখে তার পর আপনাদের ‘সদাচঞ্চল’ সোশ্যাল মিডিয়া টিমকে দিয়ে তা ভাইরাল করিয়ে আমার বলা সত্য কথাটি মানুষের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছে দেওয়ার নির্বুদ্ধিতার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।
সত্য কথা অপ্রিয়। তাই আমি জানি, আমি যা বলেছি সেটা আপনাদের গায়ে লেগেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদীজি নিজেই নিজের তুলনা। সব রাজনীতিবিদই তাই। কারও কাছে ওঁর সব কিছু ভাল। আবার কারও কাছে ওঁর সব কিছুই সমালোচনার বিষয়। রাজনীতির এটাই তো নিয়ম। তাই এক দিকে একদা আপনাদের বিপক্ষ দলের (তৃণমূল) অনুগত সৈনিক, রাজনীতির বাইরে আমার ভ্রাতৃপ্রতিম শুভেন্দু অধিকারী, যিনি প্রতিটি সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সব সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করতেন, তিনিই এখন বিধানসভায় বিজেপি-র সর্বোচ্চ নেতা হলেন। আপনারাই রোজ বুক বাজিয়ে আদর্শের কথা বলছেন! বাহ্!
কলেজে আমরা দুষ্টুমি করে একটা কথা বলতাম। সেটাতে একটু ‘দুষ্টু’ বাংলার প্রয়োগ থাকলেও না বলে পারছি না— ‘আপনি করলে লীলা আর আমরা করলে বিলা!’ এই তো মূল আদর্শের গল্প আপনাদের। আর চরম হাস্যকর হল, কংগ্রেস এবং বামপন্থীদের ‘বাঙালিদের সঙ্গে বঞ্চনার ইতিহাস’-এর প্রসঙ্গ এত কষ্ট করে জড়ো করে তার সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘বাঙালিপ্রীতির’ তুলনা করা! দুটো ‘ভুল’ জুড়ে দিলে যে একটা ‘ঠিক’ হয় না, সেটা জেনেও আপনাদের লেখাটা যে ব্যুমেরাং হয়ে যাচ্ছে সেটা বুঝছেন না। আরে বাবা, আপনাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই ‘বাঙালিবিদ্বেষী’ দলগুলিও তো এখন বাংলায় প্রায় ইতিহাস! সেই ইতিহাসের সঙ্গে মাননীয় নরেন্দ্র মোদীজির তুলনা কেন করছেন? অতুল্য ঘোষের সঙ্গে বেইমানি করে যদি ইন্দিরা গাঁধীর ইনিংস শুরু করার কথা বলেন, তা হলে ২০১৪ থেকে যে মানুষটা রাস্তায়-রাস্তায়, গলিতে-গলিতে সামনে থেকে লড়াই করেছে, তার সঙ্গেও একই রকম অন্যায় করেছে বিজেপি! তাই তত্ত্বকথা বা আদর্শ তুলে রাখুন আপনাদের সিন্দুকে! আমার গ্রহণযোগ্যতা কী, সেটা আপনারা নন, মানুষ বলবে। মাত্র দু’দিন আগে আপনাদের সদ্য অপসারিত রাজ্য সভাপতি মাননীয় দিলীপ ঘোষ মহাশয় একটি ইন্টারভিউয়ে বাঙালিকে যে ভাবে অপমান করেছেন, ছোট করেছেন, তা শুনে সারা পৃথিবীর বাঙালি ক্ষুব্ধ।
কতজন যোগ্য মানুষকে বিজেপি বসিয়ে রেখেছে, তা তো আপনারা নিজেরাও জানেন। তালিকা দেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে যে সত্য কথাগুলি যখন বললে দলের উপকার হত, সেগুলি তখন না বলে ছোট ছোট জটলা, গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের স্বার্থে দলের চূড়ান্ত ক্ষতি করেছেন। আর নীচুতলার প্রকৃত বিজেপি কর্মীদের মন ভেঙে দিয়ে, দুঃখ দিয়ে, আপনাদের আদর্শের ‘জালে’ জড়িয়ে, যাকে যেখান থেকে পেরেছেন মুড়িমুড়কির মতো দলে নিয়েছেন এবং সেই কর্মীদের বা জেলার নেতাদের মাথার উপর বসিয়েছেন। তখন যে কেন আপনাদের লজ্জা করেনি (যেমন আপনারা বলছেন আমার হওয়া উচিত) কে জানে! ক্ষমতায় আসার লোভে? একমাত্র আমিই কিন্তু তখন সৎসাহস দেখিয়েছিলাম। মনে পড়ে?
মেনে নিন যে, শুধুমাত্র ঔদ্ধত্যের কারণে একজন অনুগত কর্মীকে আপনার বিজেপি ছাড়তে বাধ্য করেছেন। মিলিয়ে নেবেন, আগামী দিনে আরও অনেকে বিজেপি ছাড়বেন। তাতে আমার কোনও ভূমিকা থাকবে না। তাঁরা বিজেপি ছাড়বেন নিজেদের তাগিদে। আপনাদের রোজকার খেয়োখেয়িতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে।
সেই জন্যই আপনাদের একটা ছোট উপদেশ দিতে চাই। আমি যেমন আপনাদের উপেক্ষা করি, আপনারাও সেটা শিখুন। আমার ‘অপ্রিয়’ সত্যি কথাগুলির জবাব মিথ্যে বা অপ্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে নিজেদের আর হাস্যস্পদ করবেন না। এক দিকে বলছেন, আমার কোনও গুরুত্ব নেই। কোনও দিন ছিল না। আবার অন্য দিকে রোজই আমাকে কোনও না কোনও ভাবে আপনাদের কথোপকথনে টেনে এনে আমার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করছেন।
আমার বুধবারের বলা সত্য কথাটি শুনতে আপনাদের যে খুব কষ্ট হয়েছে, তা আমি বেশ অনুভব করতে পারছি। কিন্তু ধৃষ্টতা মাফ করবেন। নিজের মুখেই বলছি যে, আমার বুকের পাটা আছে। তাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমার মন যা ঠিক মনে করেছে, আমি তা-ই করেছি। আমার সেই অধিকারটি কিন্তু একান্তই আমার নিজস্ব। সেটা তো মানেন। না কি?
আরও শুনুন। সাহস আছে বলেই অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ২০১৪-তে অনেকে লড়লেও একা আমিই আসানসোলে সকলকে সঙ্গে নিয়ে, বিজেপি-র বিবদমান সব গোষ্ঠীকে একসঙ্গে এনে জিতেছিলাম। আমি জিতেছি, এটা জেনে বাংলার তৎকালীন বিজেপি প্রধান টিভি ক্যামেরার সামনে কী বলেছিলেন, তা মনে করলে এখনও অস্বস্তি হয়। রাগ হয়। কিন্তু তার পরেও মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করেছিলাম। তাই কোনও ‘কয়লা মাফিয়ার’ সাহায্য ছাড়াই ২০১৯-এ তিন গুণ ভোটে জিতেছিলাম।
আপনারা ভুলে গিয়েছেন যে, দলে আমারই তথাকথিত ‘শুভানুধ্যায়ী’-রা দিল্লিতে ‘সার্ভে রিপোর্ট’ পাঠিয়েছিলেন— বাবুল আসানসোলে বিপুল ভোটে হারবেন! আমাকে পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন জমা দেওয়ার দু’দিন আগেও আসানসোল থেকে লড়তে বারণ করেছিলেন। শুনিনি। পালিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় লড়ার পাত্র আমি নই। আসানসোলে মানুষের কাজ করেছি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হয়তো বিফলও হয়েছি। কিন্তু আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি এবং তা সেখানকার মানুষ কাছ থেকে দেখেছেন। তাই দু’লাখ ভোটে জিতব— একথা প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছি। আসানসোলের সংগঠনে আমাকে এবং ওখানে যাঁরা পার্টির জন্য ভাল কাজ করছেন, তাঁদের চূড়ান্ত ভাবে উত্যক্ত করার পরেও আমরা প্রায় দু’লাখ (১,৯৭,৬৩৭) ভোটেই জিতেছি। আমার মূল্যায়ন আসানসোল করেছে। আপনারা মূল্যয়ন করার কে?
২০১৯-এ আসানসোলের মানুষের ‘তিনগুণ’ ভালবাসা পেয়ে, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ প্রায় সম্পূর্ণ করে (খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। পুরোদমে কাজ চলছে) এই আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছি যে, আমি মানুষের জন্য কাজ করতে পারি। সিদ্ধান্ত নিতে পারি। যত ক্ষণ না হচ্ছে, তত ক্ষণ লেগে থাকতে পারি আর তাই যা আমার অন্যায় বলে মনে হয়েছে, তার প্রতিবাদে মাথা উঁচু করে স্পষ্ট কথা বলে দল ছেড়েছি। আর সত্যি কথা বলুন তো, প্রমোশন পাব এই আশা করাটা কি অন্যায়? আপনারা হয়তো ‘নিঃস্বার্থ মহামানব’। এতটাই যে, ভাল কাজ করে স্বীকৃতি বা পদোন্নতির আশা কখনও করেন না। কিন্তু দুঃখিত। অত ‘মহান’ আমি নই। হতেও চাই না।
আসল সত্য হল— রাজনীতি করেছি। অনমনীয় ভাবে করেছি। কখনও কখনও টিভিতে উত্তপ্ত পরিবেশে নিজেকে উত্তেজিত ও চিৎকার করতে দেখে নিজেকেই নিজের অজানা ঠেকেছে। নিজেকে ওই ভাবে দেখে লজ্জাও পেয়েছি। কিন্তু লড়াই ছাড়িনি। কাজকেই সব সময় প্রাধান্য দিয়েছি আর তাই রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ঝালমুড়ি খেতেও দ্বিধা করিনি। ওঁর আতিথেয়তাকে সম্মান জানিয়েছি আর ঝালমুড়ি খেতে খেতে, ওঁর গাড়িতে যেতে যেতেই, ওঁকে সবিনয়ে অনুরোধ করেছি প্রায় পাঁচ বছর বন্ধ পড়ে থাকা মেট্রোর সমস্যাগুলির সমাধানে আমাকে সাহায্য করতে। বলেছি যে, কাজটির সঙ্গে আমার ভবিষ্যৎ সরাসরি জড়িত। কারণ আমিই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর থেকে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর দায়িত্ব চেয়েছি এবং তিনি সে দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী আমার কথা শুনেছেন এবং তত্কালীন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম মহাশয়কে তৎক্ষণাৎ বিষয়টি দেখার নির্দেশ দিয়েছেন।
আর আপনারা? আমার নিজের দলের ‘আপনারা’ কী করেছেন? ‘ঝালমুড়ি’ নিয়ে আমাকে চূড়ান্ত অপমান করেছেন। কী না বলেছেন! এখনও বলছেন! কিন্তু আমি সহ্য করেছি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছি আর তাই সরেজমিনে দেখতে গিয়ে যখন কাজটিকে সুষ্ঠু ভাবে এগোতে দেখেছি, তখন রাজ্য সরকার এবং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে প্রকাশ্যেই ধন্যবাদ জানিয়েছি। নোংরা রাজনীতি করিনি।
আপনাদের হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যেমন ২০১৪ থেকে লড়াই করেছি, ঠিক সে ভাবেই মানুষের কাজ করার লক্ষ্যে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে আপনাদের বিরুদ্ধেও লড়ব। পরিশেষে বলি, সত্যি কথা হজম করে আত্মসমালোচনা করার সাহস দেখান। না হলে আয়নার সামনে নিজেকে কাপুরুষ মনে হবে। জানি, কিছু বলার অধিকার বা সাহস আপনাদের কেন্দ্রীয় নেতারা দেননি। তাই আপনাদের অনেকে কষ্টে আছেন। আমিও ছিলাম। অনেক দিন। শুরু থেকেই। কিন্তু কোনও এক সময়ে আর মানতে ইচ্ছে করেনি। আপনারা রোজ রোজ আমাকে কটূক্তি করেন। তাই আমাকেও কিছু ‘তথ্য’ সামনে আনতে হল।
ভাল থাকুন। প্রধান বিরোধীদল হিসেবে আপনাদের জন্য আমার শুভেচ্ছা-ভালবাসা রইল।
পুনশ্চ: অমরেন্দ্র সিংহ বিজেপি-তে যোগ দিতে পারেন শুনলাম। উনি শেষমেশ কী করবেন জানি না। কিন্তু উনি আসতে চাইলে বিজেপি যে ওঁকে সস্নেহে ‘বরণ’ করে নেবে, এটা হলফ করে বলা যায়। তাই আমাকে নিয়ে লিখে আর সময় নষ্ট করবেন না। অনেক তো হল | বরং বিলম্ব না করে ‘অমরেন্দ্র পা’জিকে’ আক্রমণ শুরু করুন | ওঁর সব পুরনো ভিডিয়ো, যেগুলোয় উনি বিজেপি সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ‘কড়া ভাষায় কঠোর নিন্দা’ করেছেন, সেগুলো খুঁজে বার করে আপনাদের সোশ্যাল মিডিয়া টিমকে দিয়ে ‘ভাইরাল’ করান। দলবদল যে অত্যন্ত গর্হিত এবং অমার্জনীয় একটি অপরাধ, সেটা আমি দলবদল করার পরেই তো আপনারা উপলব্ধি করেছেন! তাই না? যদিও দলবদল নিয়ে আপনাদের কথাবার্তা শুনে সেই প্রবাদ মনে আসছে যে, একশো ইঁদুর খেয়ে বিড়াল চলল হজ করতে! কিন্তু তবু বলব, দয়া করে এই সিনিয়র কংগ্রেস নেতাকে এই ‘ভয়ঙ্কর পাপ’ কাজটি করতে দেবেন না। কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপি-তে ওঁকে বা আর কাউকে আসতে দেবেন না। তা তিনি যত বড় নেতাই হোন না কেন। না কি, ‘বিজেপি করলে লীলা আর...’?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy