প্রতীকী ছবি।
করোনার প্রাদুর্ভাব পর্বে রাজ্য সরকার স্কুলপড়ুয়াদের পড়াশোনার যে-ব্যবস্থা করেছে, শিক্ষা দফতরের পুস্তিকা ‘এডুকেশন ফার্স্ট’-এ তার খতিয়ান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সেই উদ্যোগ কতটা সফল হয়েছে? অনলাইন ক্লাসে মধ্যমেধার পড়ুয়ারাই বা উপকৃত হচ্ছে কতটা?
শিক্ষা শিবিরের অনেকেরই বক্তব্য, অনলাইন-পাঠের সরঞ্জাম আছে, শহরাঞ্চলের এমন সম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েরা এই ব্যবস্থায় কমবেশি উপকৃত হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু গ্রাম বা প্রত্যন্ত এলাকার অধিকাংশ পড়ুয়া এর সুফল পাচ্ছে না। পরিকাঠামোর অভাব ছাড়াও শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক-শিক্ষার্থী মুখোমুখি শিক্ষণ প্রক্রিয়ার অনেক মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা এতে নেই।
মডার্ন হাইস্কুল ফর গার্লসের ডিরেক্টর দেবী করের বক্তব্য, অনেক সময় অনলাইন ক্লাস ছেলেমেয়েদের একঘেয়ে লাগতে পারে। অনেক পড়ুয়ার অমনোযোগী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। স্কুলে ক্লাস চলাকালীন পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় পড়ুয়াদের মজার মজার কথাও বলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। অনলাইন ক্লাসে সেগুলো না-পেলে ক্লাস যান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে। ‘‘অনলাইন ক্লাসে একসঙ্গে অনেক ছেলেমেয়েকে না-পড়িয়ে ছোট ছোট ‘গ্রুপ’ বা দল করে পড়ালে সব পড়ুয়ার প্রতি সমান মনোযোগ দিতে পারবেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কিছু ক্ষণ পড়িয়ে একটু বিরতি দিয়ে ফের পড়াতে হবে। তা হলে মধ্যমেধার পড়ুয়া-সহ সকলেই উপকৃত হবে,’’ বলেন দেবী কর।
হিন্দু স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভ্রজিৎ দত্তের পরামর্শ, শিক্ষক-শিক্ষিকার দেওয়া ‘হোমটাস্ক’ বা ঘরের কাজের উত্তর পড়ুয়ারা যাতে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে না-লেখে, সে-দিকে নজর রাখতে হবে। কারণ, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কেউ উত্তর লিখে পাঠালে মধ্যমানের কোনও পড়ুয়া সেটা দেখেই লিখে দিতে পারে। ‘‘ফলে আখেরে মধ্যমেধার পড়ুয়াটির কোনও লাভই হবে না,’’ বলছেন শুভ্রজিৎবাবু।
শ্রেণিকক্ষে মুখোমুখি পড়ানোর মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা আর অনলাইনে পরোক্ষ-পাঠের অসুবিধা ব্যাখ্যা করেছেন উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারি বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৌগত বসু। তিনি বলেন, ‘‘ক্লাসরুমে মধ্যমেধার কোনও পড়ুয়া ঠিকমতো পড়া বুঝতে না-পারলে অভিজ্ঞ চোখে শিক্ষক সেই পড়ুয়ার মুখ দেখেই তা বুঝে ফেলেন। অনলাইনে শিক্ষকের পক্ষে সেটা বোঝার সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া ক্লাসে ঠিকমতো বুঝতে না-পারলে আরও ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলেমেয়েরা অনুরোধ করে। অনলাইন ক্লাসে সব সময় সেই অনুরোধ করার সুযোগ থাকে না। এর ফলে মধ্যমেধার পড়ুয়াদের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়তেই থাকে।’’
করোনার দৌরাত্ম্য ছাড়াও রাজ্যের কয়েকটি জেলায় ঘূর্ণিঝড় আমপানের হানায় অনেক ছাত্রছাত্রী ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ের আগে অনলাইন শিক্ষার সুযোগ যতটুকু মিলছিল, বহু পড়ুয়া সেটাও হারিয়েছে বলে মনে করছেন অনেক শিক্ষক। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দনকুমার মাইতি বলেন, ‘‘আমাদের জেলায় আমপানের পরে অনলাইন ক্লাস অনিয়মিত হয়ে পড়ায় অনেক গরিব ছাত্রের পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক কার্যত ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। ফের ক্লাস চালু হলে বেশি করে পড়াশোনা করে ভাল ছাত্রছাত্রীরা হয়তো ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু মধ্যমেধার পড়ুয়ারা কি সেটা পারবে?’’
জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলগুলিরও অধিকাংশ পড়ুয়া অনলাইন ক্লাস থেকে বঞ্চিত বলে জানান নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন। তিনি বলেন, ‘‘ক্লাস না-হওয়ায় প্রত্যন্ত এলাকায় সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যমেধার পড়ুয়ারা। অনলাইন ক্লাসে বৈষম্য আসছে শিক্ষায়।’’
অনলাইন ক্লাসের পরিকাঠামোয় যে দুর্বলতা আছে, শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও সেটা মেনে নিয়েছেন। ‘‘অনলাইনে সকলে সুযোগ পেলে ভাল। কিন্তু এখন যা পরিকাঠামো, তাতে সেটা সম্ভব নয়। অনলাইনে সব ধরনের পড়ুয়াকে শিক্ষা দিতে গেলে পরিকাঠামো আরও ভাল হওয়া দরকার,’’ বলেন পার্থবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy