আশিক ইকবাল
বাঁশের মাচায় আড্ডা। খানাকুলের বিভিন্ন গ্রামে এ রেওয়াজ দীর্ঘ দিনের। পোল-২ পঞ্চায়েত এলাকায় অবশ্য একটিই মাচা রয়েছে বর্তমানে। চকভেদুয়া গ্রামের কাটাখালের কাছে। গ্রামবাসীরা মাচাটি এড়িয়েই চলেন। সেখান থেকে ডাক এলে তো কথাই নেই। ঘুম উবে যায়।
গ্রাম জানে, মাচার ‘অধীশ্বর’ তৃণমূল পঞ্চায়েত প্রধান বছর বত্রিশের আশিক ইকবাল। আর সেই মাচা থেকে বিচার, ধোলাই, জরিমানার নিদান দেওয়া হয় বলেই অভিযোগ গ্রামবাসীর। একই কারণে আশিক নাকি এলাকার বাকি মাচাগুলি ভেঙে দিয়েছেন, এমন কথাও শোনা যায়।
‘‘এলাকার উন্নয়ন আর অন্যায়ের চটজলদি সাজা দিই বলেই লোকে আমাকে দাদা বানিয়েছে। তাই দাদাগিরি করছি বললে অসুবিধা নেই। কিন্তু তোলাবাজ বললে বড্ড রাগ হয়। তাই যদি হতাম, অন্যদের মতো অট্টালিকা বানাতাম, ব্যাঙ্কে অনেক টাকা জমাতাম।”— বলছেন আশিক। স্বীকারও করছেন অন্য মাচা ভেঙে দেওয়ার কথা। তাঁর দাবি, ‘‘বড্ড অপসংস্কৃতি এবং অপরাধ হচ্ছিল মাচাগুলি থেকে। প্রকাশ্যে মদ-গাঁজা খাওয়া হচ্ছিল। মাচা থেকে মহিলাদেরও উত্ত্যক্ত করা হত। একটি মাচা ভেঙে দু’টি শৌচাগার করেছি। এটা কি দোষের?’’
একেবারেই দোষের নয়। কারণ, তিনি ‘সমাজসেবা’ করেন। নিজেই জানান, সমাজের সেবায় কী কী করেছেন। কিন্তু এক জন ‘সমাজসেবী’কে গ্রামবাসীরা এত ভয় পান কেন? প্রধানের উত্তর, ‘‘আমি তো মানুষ নাকি! দোষ-গুণ থাকবে না! আমার ভাল দিকটা তো কেউ আর বলবে না! যদি খারাপই হব, তা হলে লোকসভা ভোটে আমার অঞ্চল থেকে পাঁচ হাজার ভোটে কী করে লিড দিলাম?’’
গ্রামবাসীদের অবশ্য দাবি, শুধু পোল-২ নয়, পাশের পোল-১ এবং খানাকুল-২ পঞ্চায়েতের লোকজনও আশিক এবং তাঁর বাহিনীর ‘ভয়ে কাঁপেন’। তোলা আদায়ে আপত্তি জানালে বা মুখ খুললে মারধর, ঘর ভাঙচুর আর লুটপাট চলে বলে অভিযোগ। নিজের বাহিনীকে আশিক অবশ্য ‘গ্রাম-সেবক’ বলে দাবি করেছেন। এবং যাবতীয় অভিযোগই জোর গলায় অস্বীকার করেছেন।
এ-ও ঠিক, এলাকায় আশিকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ শোনা যায়, তার বেশির ভাগটাই থানা পর্যন্ত পৌঁছয় না। পুলিশ জানিয়েছে, বর্তমানে আশিকের বিরুদ্ধে চারটি মামলা (ভাঙচুর, মারধর, লুটপাট ইত্যাদি) চলছে। চারটিতেই তিনি জামিন পেয়েছেন। এসডিপিও (আরামবাগ) নির্মলকুমার দাস জানান, মানুষকে অকারণে ভয় পেতে নিষেধ করা হয়েছে। অভিযোগকারীকে পুলিশ নিশ্চয়ই আইনি সহায়তা দেবে। অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশিকের দাবি, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে এলাকার মানুষজন কাউকে মারধর করেন, প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে নাম জড়িয়ে যায় আমার।”
থানায় যেতে কেন ভয় পান গ্রামবাসী?
রাধাবল্লভপুরের মোল্লা রফিকুল ইসলামের অভিযোগ, “মাস দেড়েক আগেই বাজারে এক চা-দোকানি চায়ের দাম চাওয়ায় আশিকরা তাঁকে মারধর করে। দেখে প্রতিবাদ করেছিলাম। সেই অপরাধে ওরা আমার বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। মারধর করে। থানায় জানালে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।’’ একই গ্রামের শেখ হাসান বলেন, “আমাদের পারিবারিক বিবাদে প্রধান অযাচিত ভাবে খবরদারি করতে এলে প্রতিবাদ করেছিলাম। তাতেই মার খেতে হয়। থানায় অভিযোগ জানাতে যাওয়ার পথে আমাকে আটকে হুমকি দেন, মারধর করেন। ভয়ে ফিরে যাই।’’
স্কুলছুট হওয়ার পরে ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ আশিকের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল মুম্বইয়ে। জরির কারিগর হিসেবে। ২০০৯ সালে ফিরে কলকাতায় তপসিয়ায় নিজের জরি কারখানা গড়েন। ২০১২ সালে গ্রামের তৃণমূল নেতাদের ডাকে ফিরে আসেন। তার পর থেকে দলে তাঁর গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। যে সব তৃণমূল নেতাদের ডাকে আশিক ফিরেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শেখ কাজল এখন এলাকাছাড়া। তাঁর অভিযোগ, “ক্ষমতায় মত্ত হয়ে ২০১৭ সালের শেষ দিকে আমাকেও খুন করার চেষ্টা করেছে আশিক। সেই থেকে আমি গ্রামে ঢুকতে পারিনি।” নাঙ্গুলপাড়ার শেখ লালবাবুর অভিযোগ, “আশিকের দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় দুর্নাম রটিয়ে ও ৫ লক্ষ টাকা দাবি করেছিল। না দেওয়ায় গত ২ জুন আমার বাড়িতে দলবল নিয়ে চড়াও হয়ে মারধর, ভাঙচুর করে।’’
জেলা তৃণমূল সভাপতি দিলীপ যাদব অবশ্য সাফ বলেন, ‘‘আশিকের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ এখনও পাইনি। পেলে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy