বরুণের দিদি প্রমীলা রায়
খুনের মামলার নিষ্পত্তি আজও হয়নি। কিন্তু মন্ত্রীর মানহানি মামলায় আদালতে হাজিরা না দেওয়ায় সুটিয়ায় নিহত বরুণ বিশ্বাসের দিদি প্রমীলা রায়ের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়ে গেল।
বরুণ খুনের বিচার চেয়ে গত তিন বছর ধরে যে আন্দোলন চলছে, তার অন্যতম মুখ প্রমীলা। খুনের পিছনে তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের হাত রয়েছে বলে টানা অভিযোগ করে আসছেন তিনি। যদিও পুলিশের খাতায় কখনও সেই অভিযোগ দায়ের হয়নি। উল্টে বিধাননগর এসিজেএম আদালতে প্রমীলার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা রুজু করেছেন মন্ত্রী।
শনিবার ওই মামলাতেই প্রমীলার আদালতে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বা তাঁর আইনজীবী না আসায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। মন্ত্রীর আইনজীবী জয়দেব দাস বলেন, ‘‘আগামী ২৪ অগস্টের মধ্যে প্রমীলাদেবীকে গ্রেফতার করে আদালতে হাজির করাতে গাইঘাটা থানাকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।’’
প্রমীলা অবশ্য দাবি করেছেন, এ দিন যে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল, সুন্দরবনে বেড়াতে চলে যাওয়ায় তিনি তা জানতেন না। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সাধারণত পরপর তিনটি তারিখে আদালতে হাজির না হলে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে প্রথম দিনেই তা জারি হল। তা সত্ত্বেও জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকই যে আমার ভাইকে খুন করিয়েছেন, তা বলে যাব।’’
তিন বছর আগে ঠিক এই দিন, ৫ জুলাই খুন হয়েছিলেন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের (মেন) বাংলা শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস। তাঁর অপরাধ, এলাকায় একের পর এক গণধর্ষণ ও দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মঞ্চ গড়ে তোলা। স্কুল থেকে ফেরার সময়ে গোবরডাঙা স্টেশনে নামতেই খুব কাছ থেকে তাঁকে গুলি করে দুষ্কৃতীরা।
বরুণের বাবা জগদীশ বিশ্বাস ও দাদা অসিতের দাবি, ‘‘প্রমীলা প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির দাবি তুলছে। ‘আমরা আক্রান্ত’-এর হয়ে বিভিন্ন প্রতিবাদ আন্দোলনেও সামিল হচ্ছে। তাই মামলা করে ওকে থামানোর চেষ্টা চলছে।’’ বরুণের মৃত্যুর পর সুটিয়ার বাড়ি ছেড়ে সস্ত্রীক কলকাতার মাদুরদহ হোসেনপুরে অসিতের কাছে চলে গিয়েছেন জগদীশবাবু।
এ দিন সকালে সুটিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, বরুণদের তালাবন্ধ বাড়ির কাছে রাস্তার পাশে সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের তরফে রবিবার স্মরণসভার প্রস্তুতি চলছে। মঞ্চের সভাপতি ননীগোপাল পোদ্দার অবশ্য বলেন, ‘‘জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক খুনের পিছনে আছেন, এমন কোনও প্রমাণ আমাদের কাছে নেই।’’ প্রমীলার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েও তিনি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে গাইঘাটার মানবাধিকার কর্মী নন্দদুলাল দাস দাবি করেন, ‘‘জ্যোতিপ্রিয়বাবু যে এই খুনে জড়িত তার যথেষ্ট প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। ভয় দেখিয়ে প্রমীলাদেবীর মুখ বন্ধ করা যাবে না।’’
জ্যোতিপ্রিয়বাবু অবশ্য অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বরুণ খুনের তিন দিনের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সিআইডি তদন্তে নেমেছিল। অভিযুক্তেরা গ্রেফতার হয়েছে। খুনের কথা স্বীকারও করেছে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক ইন্ধনে আমার সম্মানহানি করছেন প্রমীলাদেবী। কিছু বুদ্ধিজীবী তাঁকে মদত দিচ্ছেন। আদালত যা বিচার করবে তা মাথা পেতে নেব।’’
কেন এত দিনেও মেলেনি বিচার? বনগাঁ মহকুমা আদালতের মুখ্য ভারপ্রাপ্ত সরকারি আইনজীবী সমীর দাসের ব্যাখ্যা, ‘‘প্রায় দশ মাস বিচারক না থাকায় বিচার প্রক্রিয়ায় দেরি হয়েছে।’’ প্রমীলা অবশ্য দাবি
করেন, ‘‘শাসক দলের হস্তক্ষেপেই বিচার পেতে দেরি হচ্ছে।’’ চোয়াল শক্ত করে সুটিয়ার পার্বতী বিশ্বাস বলেন, ‘‘বিচার আমাদের দিতেই হবে। আজ নয় তো কাল।’’
ছেলের কথা বলতে গেলে আজও চোখে জল চলে আসে বিরাশি বছরের বৃদ্ধ জগদীশবাবুর। তাঁর স্ত্রী গীতাঞ্জলি দেবী ঘুমের মধ্যে ‘বরুণ-বরুণ’ বলে চিৎকার করে ওঠেন। এ দিন ফোনে জগদীশবাবু বলেন, ‘‘খুনিদের শাস্তির জন্য সিবিআই চেয়েছিলাম, পাইনি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করব বলে চিঠি দিয়েছিলাম। উনি দেখা করেননি। এখন ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা, প্রকৃত খুনিদের শাস্তি হয়েছে, এটা যেন দেখে যেতে পারি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy