Advertisement
৩০ নভেম্বর ২০২৪

হুকুম শুনেই হুমকি: আসছি, ওই ভাবে মারব তোদেরও

বৃহস্পতিবার বিচারভবনের বারান্দায় কামদুনি-মামলায় দোষী সাব্যস্ত আনসার আলির হুমকিতে কেঁপে উঠল নিহত ছাত্রীর পরিবার। এমনকী, অন্যেরাও। প্রচণ্ড ক্রোধে আনসার তখন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল গোটা তিরিশেক পুলিশের বেষ্টনী থেকে।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৩৮
Share: Save:

ইয়াদ রাখুঙ্গা। তুঝে ইয়াদ রাখুঙ্গা...।

জিস দিন ম্যায় ভাগ নিকলা, বহুত পছতাওগে ঠাকুর, বহুত পছতাওগে।

হাড় হিম করা চাহনি। এক মুখ দাড়ি। হলদেটে দাঁত। কালচে-সবুজ পোশাকে আদালতের বারান্দাতেই গব্বর সিংহের হুমকি পুলিশ ইনস্পেক্টর ‘ঠাকুর সাব’কে।

‘‘আসছি, আসছি। তোদেরও ওই ভাবে মারব।’’

সেই চাহনি। পেটানো চেহারা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হলদেটে দাঁত। পরনে খয়েরি জ্যাকেট।

প্রথমটা ‘শোলে’ ছবির দৃশ্য। দ্বিতীয়টা বাস্তবের।

বৃহস্পতিবার বিচারভবনের বারান্দায় কামদুনি-মামলায় দোষী সাব্যস্ত আনসার আলির হুমকিতে কেঁপে উঠল নিহত ছাত্রীর পরিবার। এমনকী, অন্যেরাও। প্রচণ্ড ক্রোধে আনসার তখন ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল গোটা তিরিশেক পুলিশের বেষ্টনী থেকে। পায়ের চটি হাতে তুলে নিয়ে সে এগিয়ে যায় নিহতের ভাই, দাদা, মা, বাবার দিকে। পুলিশ অতি কষ্টে টেনে নিয়ে যায় তাকে। ঠিক ‘শোলে’র মতোই।

নিহতের মা কোনও রকমে প্রশ্ন করেন, ‘‘এত জোর ওর এল কী করে?’’ নিহতের ভাই বলতে থাকেন, ‘‘এখনও মারতে আসছে, কী সাহস!’’

২০১৩ সালের ৭ জুন থেকে ২৮ জানুয়ারি, ২০১৬। আড়াই বছর পরে কামদুনির কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের মামলায় রায় ঘোষণা হল এ দিন। আনসার-সহ ছ’জন দোষী সাব্যস্ত। তার মধ্যে আনসার-সইফুল মোল্লা এবং আমিন আলির বিরুদ্ধে খুন ও গণধর্ষণের অপরাধ প্রমাণিত। ফলে তাঁদের ন্যূনতম কুড়ি বছর কারাদণ্ড থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। শেখ ইনামুল, ভোলানাথ নস্কর এবং আমিনুল ইসলাম গণধর্ষণ এবং ষড়যন্ত্রের অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত। তাদের ন্যূনতম কুড়ি বছর কারাদণ্ড থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন সাজা হতে পারে। তথ্যপ্রমাণের অভাবে বেকসুর দু’জন। রফিকুল গাজি ও নুর আলম।

রায় শুনতে আদালতে নিহতের পরিবারের লোকজন তো এসেছিলেনই, কামদুনি এবং আশপাশের এলাকা থেকেও ভিড় জমেছিল। বিচারকের রায় শোনার পরে সকলে এজলাস থেকে বেরিয়ে যখন সাজা নিয়ে কথা বলছিলেন, তখনই আনসার-সহ সাজাপ্রাপ্তদের কোর্ট লকআপে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আনসারকে দেখে নিহত তরুণীর মা চিৎকার করে উঠেছিলেন, ‘‘আমার কোল খালি করেছিস, তোর মৃত্যুদণ্ড চাই।’’ নিহতের ভাইও আঙুল তুলে বলেন, ‘‘এ-ই দিদিকে খুন করেছে।’’

ঠিক তখনই ভয়ঙ্কর মূর্তি ধরে আনসার। পুলিশ তখন তাকে ধরে রাখতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। আনসারের দু’টি হাত ধরে ছিলেন অন্তত দশ জন পুলিশকর্মী। তাঁরা তাকে টেনে কোর্ট লকআপের দিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য দাগি অপরাধীর মতোই ফের ভাবলেশহীন আনসার! তার পাথরের মতো মুখ দেখে তখন চমকে যান অনেকেই।

বহুপ্রতীক্ষিত বিচারের দিনটিতে অতএব আতঙ্কই সঙ্গী হয়ে রইল আদালত চত্বর থেকে কামদুনি গ্রাম, সর্বত্র। এক দিকে আনসারের হুমকি, অন্য দিকে রফিকুলদের মুক্তি। এলাকায় তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত এই দু’জন ছাড়া পেয়ে যাওয়ায় এ তল্লাটের বেশির ভাগ মানুষই আতঙ্কিত। তাঁদেরই এক জন বর্ণালী ঘোষ। কামদুনির ধর্ষিতা ছাত্রীটি তাঁর সেজো জায়ের মেয়ে ছিলেন। প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বর্ণালী বলেন, ‘‘আড়াই বছর ওরা জেলে ছিল। এত সহজে ছেড়ে দেবে আমাদের! কী হবে এ বার! ছেলেমেয়েগুলো স্কুল-কলেজে যেতে পারবে তো!’’

বুধবার রাত থেকেই এই ভয়টা চেপে বসেছিল গ্রামে। উদ্বেগে সারারাত ঘুমোতে পারেননি কামদুনি প্রতিবাদী আন্দোলনের দুই মুখ মৌসুমী আর টুম্পা কয়ালও। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এলাকার রাস্তাঘাট ছিল ফাঁকা, দোকানপাটের ঝাঁপ ফেলা। ঘন ঘন আনাগোনা করছিল পুলিশের গাড়ি। গোলমালের আশঙ্কায় গ্রামের ‘বি আর অম্বেডকর মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রে’ এ দিন মেরেকেটে ১৫-১৬ জন পড়ুয়া এসেছিল। দু’এক জন শিক্ষক-শিক্ষিকা ফিসফিস করে বলেন, ‘‘আদালতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, অনেক পলিটিক্যাল সমস্যা রয়েছে। ঝুঁকি নিতে পারলাম না।’’

আপাত নির্লিপ্তির আবরণে বৃহস্পতিবার সারাদিনই কামদুনির ভিতরে ভিতরে বয়েছে এ রকম নানা আশঙ্কার চোরাস্রোত আর ভয়। তাই হয়তো গ্রামের ভিতর থেকে বাসভর্তি করে গ্রামবাসীদের নিয়ে কোর্টে যাওয়ার পরিকল্পনায় শেষ পর্যন্ত দাঁড়ি পড়ে যায়। বাসে একসঙ্গে যাওয়া দূরে থাক, টুম্পা-মৌসুমী-শিক্ষক প্রদীপ মুখোপাধ্যায় ছাড়া তেমন ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি প্রতিবাদী মঞ্চের লোকজনকে। টুম্পা-মৌসুমীও আদালতে গিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের গাড়িতে। তাঁরা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে দু’টি টাটা সুমোতে আদালতে যেতে দেখা যায় ধর্ষিতার পরিবারের লোকজন এবং তৃণমূল প্রভাবিত শান্তিরক্ষা কমিটির কয়েক জনকে।


কামদুনি: অপেক্ষার আড়াই বছর

প্রতিবাদী মঞ্চের সদস্যরা তা হলে কোথায় গেলেন? টুম্পা-মৌসুমীর দাবি, ‘‘অনেকেই এসেছেন আলাদা-আলাদা ভাবে।’’ কিন্তু কামদুনিতে কান পাতলে শোনা গিয়েছে আতঙ্কের সুরই। ভয় আরও বাড়িয়েছে রফিকুল আর নুরের গ্রাম পাড়-খড়িবাড়ির উল্লাস। টুম্পার গলাতেও তাই উদ্বেগের রেশ, ‘‘ওরা তো বেকসুর খালাস পেয়ে গেল। আমাদের এখন আরও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হবে। আগামী দিনে কী হবে কে জানে!’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy