অধ্যাপক সুরঞ্জন দাস এবং অধ্যাপক শান্তনু চক্রবর্তীর এই বই ভারতের প্রতিবেশী অঞ্চলসমূহের বিশ্লেষণে একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংযোজন। বইটি ভারত ও তার কিছু নির্দিষ্ট প্রতিবেশী অঞ্চলের ও দু’টি বিশেষ পড়শি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রসমীক্ষার মধ্যে দিয়ে আলোচিত হয়েছে। লেখকরা নানা বৈচিত্রময় অধ্যায়ের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, নয়াদিল্লির বিদেশনীতি ঠান্ডা যুদ্ধের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট ধারায় বিবর্তিত হয়েছে। বহিঃশক্তির চাপ এবং অভ্যন্তরীণ ভুল পদক্ষেপের কারণে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এশিয়ায় আঞ্চলিক নেতৃত্বকে ধরে রাখার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভারত অবিচল। কিন্তু, চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে তৈরি উত্তেজনা প্রতিবেশী অঞ্চলগুলির সঙ্গে নয়া দিল্লির সম্পর্কে নানা বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। দিল্লির সবচেয়ে জরুরি কাজ হল প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা, ঐতিহাসিক সভ্যতাগত সম্পর্ককে কাজে লাগানো, সর্বতোভাবে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে উৎসাহিত করা, নতুন সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন, এবং নিছক আঞ্চলিক তত্ত্বাবধানের পরিবর্তে বৈধ নেতৃত্বে জোর দেওয়া।
ভারতের বিদেশনীতি দীর্ঘ কাল ধরে তার আঞ্চলিকতার অগ্রাধিকারের উপরে জোর দিয়েছে। এশিয়া এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের জন্য উপমহাদেশে ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলকে সঠিক ভাবে বোঝা ও যথোপযুক্ত নীতি নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যবশত, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সখ্যের অভাব প্রায়শই ভারতের বিদেশনীতির লক্ষ্য উপমহাদেশে ঘনীভূত করে, যার ফলে আমাদের বৃহত্তর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যাগুলি মোকাবিলা করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে প্রতিবেশী দেশগুলির বৈদেশিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বিশেষ ও প্রাথমিক অগ্রাধিকার প্রদানের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করার একটি নতুন পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। বিভিন্ন পড়শি অঞ্চলের সঙ্গে সুসম্পর্ক নির্মাণ, ভুটানের সঙ্গে চিরাচরিত সুসম্পর্ককে নতুন আঙ্গিকে পুনরুজ্জীবিত করার মধ্যে দিয়ে ভারত চিনের আঞ্চলিক প্রভাবকে প্রতিহত করতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে।
একই ভাবে, কাবুলে তালিবানদের ফিরে আসা সত্ত্বেও ভারতের আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা দরকার। পাশাপাশি, জ্বালানি শক্তির নিরাপত্তা ভারতের বিদেশনীতির একটি মূল উপাদান। ভারতে আর্থিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানির চাহিদাও বাড়বে; তাই মধ্য এশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা নিঃসন্দেহে ভারতের বিদেশনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের মতো বিভিন্ন বহুপাক্ষিক পরিসরে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে ভারতের নেতৃত্বের বৈধতায় প্রতিবেশী দেশসমূহের সমর্থনও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এর সঙ্গে যোগ করতে হবে নানা আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন, যা ভারতের মতো দেশের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই নানাবিধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হওয়া দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে একটি আঞ্চলিক/উপ-আঞ্চলিক মাত্রা যোগ করে, আর এই অঞ্চলগুলিকে সামগ্রিক ভাবে বুঝতে সাহায্য করে। প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য তার ‘নরম শক্তি’ (সফট পাওয়ার) যা কূটনীতির অন্যতম ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের প্রসার এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উপর জোর দিয়ে ভারত বিভিন্ন দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ককে উন্নীত করে দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করতে আগ্রহী।
বৃহৎ শক্তির বৈদেশিক নীতি একটি অনির্দিষ্ট সভ্যতাগত মোড় নিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ যদি ভারতকে সঠিক ভাবে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করে, তা হলে ভারত বিশ্বব্যাপী তার ভাবমূর্তির বিনিয়োগের সুফল পেতে পারে। একটি প্রাচীন সভ্যতা এবং একটি সমসাময়িক মহান শক্তি হিসাবে ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ নীতির চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ভারতীয় বিদেশনীতির প্রধান লক্ষ্য এশিয়া মহাদেশে তার প্রতিপত্তি, প্রভাব ও নেতৃত্বের বৈধতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। মোটের উপরে এই বক্তব্য বইটির সংক্ষিপ্তসার।
ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য নেবারহুড: কেস স্টাডিজ়
সম্পা: সুরঞ্জন দাস, শান্তনু চক্রবর্তী
৩৫০.০০
ফ্রন্টপেজ
আলোচ্য বইটি ভারতের দক্ষিণ এশিয়া নীতি, ভুটান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতের মিথস্ক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। যদিও বইটিতে কোনও উপসংহার নেই, সমস্ত অধ্যায় বিস্তৃত ভাবে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপিত করেছে। প্রথমত, এটি ওই দেশ ও অঞ্চলগুলির সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক ভাবে যে সভ্যতাগত যোগসূত্র ছিল তার উপরে জোর দিয়ে, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সেই সম্পর্কগুলি পুনরুদ্ধার করার কথা বলে। দ্বিতীয়ত, এটি ভারতের বহুমুখী আঞ্চলিক বাধা ও চ্যালেঞ্জ বোঝার জন্য প্রতিষ্ঠান গঠন এবং একটি আঞ্চলিক দৃষ্টিভঙ্গির সপক্ষে বেশ কিছু শক্তিশালী যুক্তি পেশ করে।
তৃতীয়ত, আফগানিস্তানের সামরিকীকরণ হোক বা ভারতের বিভিন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপকারী চিনা উপস্থিতি, অথবা এশীয় ভূ-রাজনীতির সামগ্রিক জটিলতা ও নানা দেশের মধ্যে বেড়ে চলা সামরিক প্রতিযোগিতা, এই সব বিষয়ে লেখকরা পরামর্শ দেন যে, আমাদের এগিয়ে যাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হল যৌথ প্রচেষ্টাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং শান্তির উদ্দেশ্যে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা। চতুর্থত, এই নানা অঞ্চল জুড়ে তৈরি হওয়া বহু নতুন প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি ও সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে সদর্থক ভূমিকা পালন করা ভারতের বিদেশনীতির একটি এটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
পঞ্চমত, যদিও গ্রন্থের সমস্ত অধ্যায় সমসাময়িক সামরিক ও কৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করে, লেখকরা বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের প্রবণতাকে শুধুমাত্র সামরিক শক্তির নিরিখে ব্যাখ্যার বিরোধী। তাঁরা নিরলস ভাবে পাঠকদের মনে করিয়ে দেন যে, ভারতকে তার বৈচিত্রময় জাতীয় স্বার্থ উপলব্ধি করার জন্য সামরিক এবং পেলব, উভয় শক্তির উপাদানসমূহকে সংবেদনশীল ভাবে মিশ্রিত করতে হবে। ষষ্ঠত, লেখকেরা মানবিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক এবং জলবায়ু সংক্রান্ত সমস্যাগুলিকে স্বীকৃতি দিয়ে বৈদেশিক নীতিকে একটি মানবিক রূপ দেওয়ার কাজে ভারতকে আগুয়ান হতে বলেছেন। এই সকল সমস্যা কেবল সম্মিলিত ভাবে সমাধান করা যেতে পারে। পথ কঠিন ও সমস্যাসঙ্কুল; কিন্তু, অন্ধ ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এই সহযোগিতার রাজনীতিকে পরাভূত করলে তা অনিবার্য ভাবে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সঙ্কট তৈরি করবে— তা লেখকেরা সঠিক ভাবেই তুলে ধরেছেন। অবশেষে, ভারতের সীমান্তবর্তী প্রতিটি অঞ্চলে চিন কী ভাবে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে তার যোগ্য বর্ণনা আছে সব ক’টি অধ্যায়ে। সম্পাদকদ্বয় প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদ। তাই তাঁরা বার বার আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, এক দিন এই অঞ্চলে রেশম পথে বিপুল ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল এবং সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়ার বৈচিত্র এশিয়ার জনগণকে নানা ভাবে সমৃদ্ধ করেছিল। এশীয় মিত্রতার দিকে লক্ষ্য এই সমৃদ্ধ গ্রন্থের বইটির কেন্দ্রীয় বার্তা।
ভূ-কৌশলগত বিশ্লেষকরা নিঃসন্দেহে এই যুক্তির সঙ্গে একমত হবেন না। কিন্তু আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব স্বয়ংক্রিয় ভাবে উদ্ভূত হয় না। এমন এক সময়ে যখন বিশ্ব যথেষ্ট হিংসা ও রক্তপাত প্রত্যক্ষ করছে, বৈদেশিক নীতির উপর একটি বই যা আঞ্চলিকতা, মানবতাবাদ, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার পুনরাবিষ্কার এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার পক্ষে যুক্তি দেয়, তা যুক্তির নতুনত্বের বিচারে, অভিনবত্বে ও নৈতিকতার অনিবার্য গুরুত্বের নিরিখে কৃতিত্বের দাবি রাখে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy