বক্তৃতা শুরুর আগে। নিজস্ব চিত্র।
আগের ভোররাত পর্যন্ত দাঁতে ব্যথা। বাড়িতে চিকিৎসক ডাকতে হচ্ছে। কিন্তু বাংলায় দাঁতে দাঁত চেপে লড়াইয়ের দাওয়াই দলকে দেওয়ার দায়িত্ব তো তাঁরই!
অতএব, রবিবারের কলকাতায় যথাসময়েই হাজির তিনি। এলেন, দেখলেন এবং বললেন, “দিদি দেখতে পেলে দেখে নিন, শুনতে পেলে শুনে নিন! ম্যায় হুঁ অমিত শাহ!” কলকাতার রাজপথ হঠাৎ যেন শুনল ‘ডনে’র সংলাপ! তার অবশ্য কারণও ছিল। সারদা-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের মোকাবিলা করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি নেতৃত্বকে এখন নিয়মিতই কড়া আক্রমণ করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নাম না-করে কটাক্ষ করছেন অমিত, সিদ্ধার্থনাথ সিংহদের। এমনকী, কয়েক দিন আগেই আক্রমণ করতে গিয়ে বেসামাল হয়ে অশালীন শব্দও শোনা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর মুখে। সে সবের হোমওয়র্ক করেই এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদীর বিশ্বস্ত সেনাপতি। তাই “ম্যায় হুঁ অমিত শাহ!”
মুখ্যমন্ত্রীকে জবাব দিতে গিয়েও বিনয় আর আত্মবিশ্বাসের অদ্ভুত মিশেল ঘটালেন অমিত। দিদিকে শোনাতে চেয়ে নিজের পরিচয় দিলেন বিজেপি-র সামান্য কার্যকর্তা হিসাবে। কিন্তু পরক্ষণেই ঘোষণা “বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি হিসেবে তৃণমূলকে উপড়ে ফেলতে এসেছি!” আসার আগে অবশ্য টেনশনে পড়েছিলেন রাহুল সিংহেরা। রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে যুদ্ধ করে, আদালতে গিয়ে এত কাঠখড় পুড়িয়ে সভার আয়োজন। তার পরে মুখ্য আকর্ষণই যদি দাঁতের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে না আসেন? আশ্বস্ত করেছিলেন অমিত নিজেই। বলেছিলেন, কলকাতায় তৃণমূলকে নিশানা করার জন্য তিনি প্রয়োজনে স্ট্রেচারে শুয়ে হলেও আসবেন! দিনভর উদ্বিগ্ন স্ত্রী সোনাল ফোনে খোঁজ নিয়েছেন। অমিত অবশ্য কলকাতা ছেড়েছেন হাসিমুখেই।
বিজেপি সভাপতির মুখে হাসি এনেছে এ দিনের সমাবেশই। মালদহের অসিত সাহা, শিলিগুড়ির উজ্জ্বল বিশ্বাস, পাপ্পু চৌরাসিয়া, বর্ধমানের সোমা দাস বৈরাগ্য বা দক্ষিণ দিনাজপুরের বংশীহারির মতিলাল সাহারা এর আগে কলকাতায় কোনও রাজনৈতিক সমাবেশে আসেননি। তাঁদের এ দিন ধর্মতলায় টেনে এনেছিল মোদী-অমিতের নামই। এমনকী, ম্যাডিসন স্কোয়ারে মোদীর পারফরম্যান্স দেখে মুগ্ধ, সুদূর আমেরিকায় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে কর্মরত তরুণ যুধাজিৎ সেন মজুমদার পর্যন্ত ফাঁক পেয়ে ধর্মতলায় হাজির! নদিয়ার নাকাশিপাড়ার নীলকমল সরকার বা ঝাড়গ্রামের বিশ্বজিৎ মণ্ডল সমাবেশ দেখে আপ্লুত হয়ে বলে ফেলেছেন, “আমরা নিশ্চিত, ২০১৬-এ বিজেপি-ই এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসছে!”
আপ্লুত অমিতও। তিনি সমাবেশেই বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, মহারাষ্ট্র বা হরিয়ানার মতো রাজ্যে তাঁদের জয় কিছু নয়! এর পরে ঝাড়খণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীর বা পরে বিহার, উত্তরপ্রদেশে জিতলেও কিছু এসে যাবে না। আসল বিজয় হবে ২০১৬-এ বাংলার তখতে পৌঁছতে পারলেই! কেন্দ্রে শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সভাপতি যদি কলকাতায় এসে বলে যান বাংলার জয় পেলে তবেই আসল আনন্দ, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের উৎসাহ বাড়তে বাধ্য। এবং সেটাই বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন অমিত কলকাতা ছাড়ার আগে। সমাবেশ সফল করতে ‘বাপ কা বেটা’র মতো ময়দানে নেমেছিলেন বলে বিমানবন্দরে পিঠ চাপড়ে দিয়ে গিয়েছেন রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি রাহুলবাবুর!
রাজ্যের বিজেপি নেতারা অবশ্য পুরোপুরি তৃপ্ত নন। রাহুলবাবুর দাবি, কোথাও রাস্তা কেটে, কোথাও অবরোধ করে বা কোথাও বিজেপি সমর্থকদের মারধর-হুমকি না দেওয়া হলে এ দিনের সমাবেশে আরও অনেক মানুষ আসতেন। এমনকী, বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের মতো কিছু জায়গায় বিজেপি-র সমাবেশের সম্প্রচার চলাকালীন কেব্ল সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ।
তৃণমূল অবশ্য কোনও অভিযোগই মানেনি। অমিতের ডন-সুলভ হুঙ্কারকে প্রকাশ্যে গুরুত্বও দিতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্ব। শাসক দলের বর্ষীয়ান নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় কটাক্ষ করেছেন, “বিজেপি-র সভায় লোক হয়নি বলে আমরা দুঃখিত। ওরা আমাদের সঙ্গে অলক্ষে একটা প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। সেটা ফ্লপ করেছে! বক্তাদের বক্তৃতাতেও সেটা ধরা পড়েছে।” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের তাচ্ছিল্য-ভরা দাবি, “কলকাতার বুকে ওঁরা যে সভা করলেন, আমাদের ব্লক সভাপতিরা ওই রকম করে থাকেন!” সঙ্গে সুব্রতবাবুর আরও কটাক্ষ, “গুন্ডা-সর্দারেরা যদি সিবিআই নিয়ে আমাদের আক্রমণ করে, তা হলে তার প্রতিবাদ করছি!” প্রসঙ্গত ‘গুন্ডা-সর্দার’ শব্দবন্ধটি অমিতের জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছেন মমতাই। দিদির কাছে নম্বর বাড়ানোর জন্য তাঁর সুরেই তাই প্রতি-আক্রমণে গিয়েছেন সুব্রতবাবুরা।
কিন্তু যে সভাকে তাঁরা ‘ফ্লপ’ বলছেন, তারই পাল্টা হিসেবে আবার আজ, সোমবার শহিদ মিনার ময়দানে যুব তৃণমূলের ডাকে ভরপুুর সমাবেশ! ‘যুবরাজ’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখেই সেখানে অমিত-মোকাবিলা করার কথা তৃণমূলের। এমনকী স্বয়ং তৃণমূল নেত্রীকেও সেখানে হাজির করানোর চেষ্টায় আছে দলের একাংশ। পাল্টা সভা ডাকা মানেই যে মূল সভাকে গুরুত্ব দেওয়া, তা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই। দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “দু’জন সাংসদ, এক জন বিধায়ক আর কলকাতায় তিন কাউন্সিলর থেকে একটা দলকে রাজ্যে ক্ষমতায় আনার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ওঁরা। ওঁদের খাটো করে দেখা যাবে না!”
বিজেপি-র অবশ্য এত চিন্তা নেই। উত্থান দিবসে’র সমাবেশে এ দিনই যেমন সংক্ষিপ্ত ভাষণে তৃণমূলকে ‘নির্মূল কংগ্রেস’ করার ডাক দিয়ে বিজেপি-র গায়ক-মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় শুনিয়েছেন, “কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে!” ওটাই অমিত-রাহুলদের সমাবেশের আবহ সঙ্গীত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy