(উপরে বাঁ দিকে) কল্যাণ চৌবে। (উপরের ডান দিকে) বাগদায় বিজেপি প্রার্থীকে ঘিরে বিক্ষোভ। (নীচের বাঁ দিকে) ফুলবাগান থানার সামনে বিক্ষোভরত বিজেপি কর্মী-সমর্থকেরা। (নীচের ডান দিকে) রানাঘাটে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটাররা। ছবি: সংগৃহীত এবং ফাইল চিত্র।
কোথাও কালো পতাকা, কোথাও গো ব্যাক বা চোর স্লোগান, কোথাও আবার ঘিরে ধরে বিক্ষোভ! গত লোকসভা নির্বাচনে ভোটের দিন যে কায়দায় বিরোধী প্রার্থীদের রোখার কৌশল নিতে দেখা গিয়েছিল তৃণমূলকে, রাজ্যের চার বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেও সেই ‘ম্যানমার্কিং’ই ছিল শাসকদলের রণনীতি! অন্তত দৃশ্যত।
মানিকতলায় বিজেপি প্রার্থী কল্যাণ চৌবেকে ঘিরে জায়গায় জায়গায় বিক্ষোভ দেখা গেল। পদ্মপ্রার্থীর গাড়িতে লাথি, ইট নিয়ে ধাওয়া করার অভিযোগ উঠল তৃণমূলের কর্মীদের বিরুদ্ধে। বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ উঠেছে উত্তর ২৪ পরগনার বাগদাতেও। নদিয়ার রানাঘাট দক্ষিণেও একই অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। তুলনামূলক ভাবে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে।
সোমবার যে চার কেন্দ্রে উপনির্বাচন ছিল, তার মধ্যে তিনটি অর্থাৎ বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ ও রায়গঞ্জে গত লোকসভা ভোটের নিরিখে এগিয়ে বিজেপি। তৃণমূল একমাত্র এগিয়ে মানিকতলায়। উপনির্বাচনের আগে থেকেই বিরোধী শিবির দাবি করে আসছে, চারটের মধ্যে অন্তত তিনটে আসনে ভোট লুটের পরিকল্পনা রয়েছে শাসকদলের। ভোটের পর তাদের বক্তব্য, তারা প্রথম থেকে যা ভেবেছিল, তা-ই হয়েছে। ভোট লুটের অভিযোগ তুলে মানিকতলার ৮৯টি বুথে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে বিজেপি। পদ্ম শিবিরের বক্তব্য, মানিকতলা কেন্দ্রের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে তারা এগিয়েছিল। বিশেষত ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে গত লোকসভা ভোটে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ভোটে তৃণমূলের থেকে এগিয়েছিল তারা। উপনির্বাচনে সেখানে দেদার ছাপ্পা দিয়েছে তৃণমূল। এই অভিযোগ তুলে ফুলবাগান থানার সামনে অবস্থান-বিক্ষোভ করেন বিজেপির নেতা-কর্মীরা। বিজেপির উত্তর কলকাতার সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তমোঘ্ন ঘোষ বলেন, ‘‘আমি থানায় যাওয়ার পর বেশ কিছু ক্ষণ আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কেউ কথা বলতে চাননি। তখন আমি বাইরে এসে বসে পড়ি। তার পর পুলিশ কথা বলতে আসে। নির্লজ্জ ভাবে ভোট লুটে পুলিশ তৃণমূলকে সাহায্য করছে। গলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তৃণমূলের গুন্ডাবাহিনী। পুলিশ নিষ্ক্রিয়। লজ্জা হওয়া উচিত, কারণ এ ভাবে গণতন্ত্রকে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে।’’
বিজেপির অভিযোগ মানতে নারাজ শাসকদল। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘কল্যাণ চৌবে ২০২১-এ হারার পর তিন বছর এলাকায় নেই। উনি মামলা করে উপনির্বাচনে বাধা দিয়েছেন। সাধন পাণ্ডের মৃত্যুর পরেও ভোট আটকে দিয়েছিলেন, তাতে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হন। সুপ্রিম কোর্টের বকুনিতে মামলা তোলা হয়। এত দিন পর আবার প্রার্থী হয়ে হাজির হয়েছেন সেখানেই। এত কিছু উনি করেছেন, মানুষের ক্ষোভ থাকবে না? এখন এ সব নাটক করলে হবে?’’
চার কেন্দ্রের মধ্যে মানিকতলাতেই সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেখানে ভোট পড়েছে ৫১.৩৯ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে রায়গঞ্জে, ৬৭.১২ শতাংশ। রানাঘাট দক্ষিণে ৬৫.৩৭ শতাংশ, বাগদায় ৬৫.১৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। মানিকতলার মতো বাগদাতেও শাসকদলের বিরুদ্ধে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ তুলেছে বিরোধী শিবির। রানাঘাট দক্ষিণে আবার বিজেপির ক্যাম্প অফিস ভাঙার অভিযোগ উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে।
মানিকতলা
২০২১ সালে মানিকতলা কেন্দ্রে জিতেছিল তৃণমূল। বিধায়ক হয়েছিলেন সাধন পাণ্ডে। তাঁর মৃত্যুর পর ওই কেন্দ্র বিধায়কহীন হয়ে পড়ে। নানা আইনি জটিলতায় এত দিন মানিকতলায় উপনির্বাচন আটকে ছিল। আদালতের হস্তক্ষেপে সেই বাধা কেটেছে। ওই কেন্দ্রে সাধনের স্ত্রী সুপ্তি পাণ্ডেকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। কল্যাণ বিজেপির প্রার্থী। বুধবার ভোটের দিন তাঁকে ঘিরে মানিকতলা থেকে কাঁকুড়গাছি— প্রায় সর্বত্রই বিক্ষোভ দেখাল তৃণমূল। দফায় দফায় তাঁকে ঘিরে চোর চোর স্লোগানও দেওয়া হল। অভিযোগ, এলাকায় বিজেপি প্রার্থীর গাড়ি ঢুকতেই তেড়ে যান তৃণমূলের কর্মীরা। কল্যাণ দাবি করেন, ভুয়ো ভোটার ধরতে যাওয়ার কারণেই তাঁকে বাধা দিয়েছে শাসকদল। তাঁর গাড়িতে লাথি, পরে পিছু ধাওয়া করারও অভিযোগ উঠেছে। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে এসে তৃণমূল সমর্থকদের সঙ্গে বচসায় জড়ান কল্যাণ। অভিযোগ, তাঁকে দেখে তৃণমূল সমর্থকেরা ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দেন।এমনকি, ‘চোর চোর’ স্লোগানও শুনতে হয় তাঁকে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়ায় এলাকায়। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডেও বহিরাগত তাণ্ডবের অভিযোগ তুলেছে সিপিএম ও বিজেপির। মানিকতলার সিপিএম প্রার্থী রাজীব মজুমদার বলেন, ‘‘ভোটের নামে বেশ কিছু জায়গায় প্রহসন হচ্ছে। আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানীয় ভোটারদের তুলনায় বহিরাগতদের সংখ্যা বেশি। পুলিশ নীরব।’’ বিজেপির অভিযোগ, ১৬ এবং ৩১ ওয়ার্ডে বাইরে থেকে গুন্ডাবাহিনী এনে ভোট করাচ্ছে তৃণমূল। যদিও তৃণমূলের পাল্টা দাবি, বিজেপি সাংগঠনিক দুর্বলতা ঢাকতে এমন অভিযোগ করছে।
বাগদা
মতুয়া অধ্যুষিত উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা বিধানসভা উপনির্বাচনে এ বার লড়াই ছিল চতুর্মুখী। তৃণমূল এই আসনে প্রার্থী করেছে ঠাকুরনগরের মতুয়াবাড়ির সদস্য, দলের রাজ্যসভার সাংসদ মমতা ঠাকুরের মেয়ে মধুপর্ণা ঠাকুরকে। মতুয়াদের বড়মা বীণাপাণি দেবীর ঘরের দখল ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে নিজেরই কাকার ছেলে শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে অনশনে বসেছিলেন মধুপর্ণা। মতুয়া প্রজন্মের নতুন মুখ, ২৫ বছর বয়সি সেই তরুণীকেই ভোট-রাজনীতিতে নামিয়েছে তৃণমূল। বিজেপির হয়ে বাগদায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন বিনয়কুমার বিশ্বাস। কংগ্রেসের হয়ে লড়াইয়ে অশোককুমার হালদার। ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী গৌরাদিত্য বিশ্বাস। বাগদাতেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘গো-ব্যাক’ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। অভিযোগ, বিজেপি প্রার্থীর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁকে মারধর করা হয়েছে বলেও দাবি। অন্য দিকে, ডিহিলদহে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তৃণমূল কর্মীরা। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে আমাদের মারধর করাচ্ছে বিজেপি।’’
রানাঘাট দক্ষিণ
রানাঘাট দক্ষিণ কেন্দ্রে মুকুটমণি অধিকারীকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। গত লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন মুকুটমণি। বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে লোকসভায় রানাঘাট কেন্দ্রে প্রার্থীও হয়েছিলেন। যে কারণে রানাঘাট দক্ষিণ বিধায়কশূন্য হয়ে পড়ে। মুকুট হেরেছেন লোকসভা ভোটে। এ বার তৃণমূলের টিকিটে রানাঘাট দক্ষিণের প্রার্থী তিনি। বিজেপি দাঁড় করিয়েছিল মনোজকুমার বিশ্বাসকে। বুধবার ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার পর থেকেই রানাঘাটের কয়েকটি জায়গায় অশান্তির ঘটনার অভিযোগ উঠেছিল। মঙ্গলবার রাতে পায়রাডাঙা এলাকায় বিজেপির এজেন্টদের বাড়িতে তাণ্ডব চালানোর অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই উত্তপ্ত ছিল এলাকা। এলাকার বিভিন্ন সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর করা বলেছে বলে অভিযোগ। বিজেপি এজেন্টের দাবি, তৃণমূলআশ্রিত দুষ্কৃতীরাই এই হামলা চালিয়েছে। যদিও তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই ঘটনায় জেলা নির্বাচনী আধিকারিক এবং পুলিশ সুপারের কাছ থেকে রিপোর্ট তলব করেছে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিকের দফতর।
রায়গঞ্জ
রানাঘাট দক্ষিণের মতো রায়গঞ্জেও লোকসভায় হারা প্রার্থী কৃষ্ণ কল্যাণীকে প্রার্থী করে তৃণমূল। বিজেপির প্রার্থী মানসকুমার ঘোষ। তাঁকে ঘিরেও কয়েকটি জায়গায় ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। মানসের দাবি, মিলনপাড়ার ছ’নম্বর বুথে কয়েক জন বুথ জ্যাম করার চেষ্টা করছিলেন। তা দেখে বাধা দিতে গিয়েছিলেন তিনি। হেমতাবাদে গিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্ত মজুমদার দাবি করেন, রায়গঞ্জে এ বার ভোট লুট করে জিততে চাইছে তৃণমূল। ভোট যদি ঠিকঠাক হয়, তা হলে মানুষের রায় বিজেপির সঙ্গেই রয়েছে। তৃণমূল অবশ্য এই সব অভিযোগ মানতে চায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy