ঘনঘটা: কালো মেঘে ঢেকেছে শহরের আকাশ।
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ক্যালেন্ডারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চপদস্থ পুর আধিকারিকটি। বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘আবার বর্ষা এল! আগের বার ক’টা বাড়ি ভেঙেছিল যেন!’’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে স্বগতোক্তি, ‘‘এ বার ক’টা ভাঙবে কে জানে!’’
এস এন ব্যানার্জি রোডে কলকাতা পুরসভার কেন্দ্রীয় ভবনে কর্মরত অফিসারদের একাংশের কাছে বর্ষা আসলে শঙ্কা, অনিশ্চয়তার ঋতু! বিপজ্জনক বাড়ির বাসিন্দাদের মতোই। কারণ, বিপজ্জনক কাঠামোর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা শহরের প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাড়ি যখন-তখন ভেঙে পড়ার যে আশঙ্কা রয়েছে, তা বহু গুণ বেড়ে যায় বর্ষা এলে। এ বছর সেই ভয়ের শুরু ১১ জুন থেকে। যে দিন আলিপুর আবহাওয়া দফতর ঘোষণা করেছিল কলকাতা-সহ রাজ্যে বর্ষা আগমনের খবর।
সে দিন বর্ষা-আগমনীর ঘোষণা হলেও আষাঢ় কিন্তু তখনও আসেনি। তখনও জৈষ্ঠের শেষ লগ্ন। মাসের নিরিখে বর্ষার জয়যাত্রার শুরু আজ শুক্রবার, পয়লা আষাঢ় থেকে। কিন্তু কে-ই বা তা মনে রাখে! কারণ, প্রতি বছর পয়লা আষাঢ়ে স্মরণযোগ্য বৃষ্টি যে হয়েছে, এমন তো নয়! তাই মনে রাখার দায়ও নেই।
আলিপুর আবহাওয়া দফতরের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ১৬ জুন, পয়লা আষাঢ়ে শহরে বৃষ্টি হয়েছিল ১০.৮ মিলিমিটার। পরবর্তী কালে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের (স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২৮১ মিলিমিটার, সেখানে গত বর্ষার মরসুমে হয়েছিল ১৪২৯ মিলিমিটার) থেকে ১২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হলেও গত বছর আষাঢ়ের প্রথম দিনে কিন্তু বর্ষার পারফরম্যান্স ছিল মাঝারি। এবারও আষাঢ়ের প্রথম দিনে বৃষ্টি নিয়ে নিশ্চিত নয় আবহাওয়া দফতর। দফতরের অধিকর্তা গণেশকুমার দাস বলছেন, ‘‘আগামী এক সপ্তাহ বর্ষার পারফরম্যান্স খারাপ থাকবে।’’
ফলে বর্ষা নিয়ে যত ‘আহ্লাদ’ই থাকুক না কেন, কালিদাসের ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ প্রবাদসম পংক্তিটুকু ছাড়া পয়লা আষাঢ়ের সঙ্গে বাঙালির যোগ অত্যন্ত ক্ষীণ। তিথি-লগ্নের হিসেবেও পয়লা আষাঢ়ের বাড়তি তাৎপর্য নেই। ‘‘আষাঢ়ের সবথেকে বড় অনুষ্ঠান হল অম্বুবাচী। সেই অম্বুবাচী যদি পয়লা আষাঢ় পড়ে, তা হলে তারিখ হিসেবে তা গুরুত্বপূর্ণ। না হলে পয়লা আষাঢ় আলাদা ভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়।’’— বলছিলেন পঞ্জিকা গবেষক গৌতম ভদ্র।
কিন্তু পয়লা আষাঢ় নিয়ে এই বিস্মৃতির দিনেও ব্যতিক্রম সেই আদি-অনন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! কালিদাসকে স্মরণে রেখে ‘মেঘদূত’-এ লিখেছেন, ‘কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে/কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/ লিখেছিলে মেঘদূত!’ অবশ্য রবীন্দ্রনাথও যখন এই কবিতাটি লিখছেন, তখন কিন্তু আষাঢ় নয়। অধ্যাপক অমিয় দেব বলছেন, ‘‘মেঘদূত কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ১৮৯০ সালের ৭ ও ৮ জৈষ্ঠ, দু’দিন ধরে। অপরাহ্নে ঘন বর্ষায় বসে ওই দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন তিনি।’’
সেই রবীন্দ্রনাথই আবার ‘বর্ষা-আহ্লাদে’ সিক্ত হয়ে শিলাইদহে বসে ১৮৯২ সালের (বাংলায় ১২৯৯ বঙ্গাব্দ) ২রা আষাঢ় একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘‘কাল আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বর্ষার নব রাজ্যাভিষেক বেশ রীতিমতো আড়ম্বরের সঙ্গে সম্পন্ন হয়ে গেছে।... মেঘদূত লেখার পর থেকে আষাঢ়ের প্রথম দিনটা একটা বিশেষ চিহ্নিত দিন হয়ে গেছে, নিদেন আমার পক্ষে।’’ অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের একটা বর্ষা-আহ্লাদ ছিল। তাতেই গান বেঁধেছেন, কবিতা লিখেছেন। আষাঢ়ও এসেছে নানা লেখায়, কবিতা, চিঠিপত্রে।’’ যদিও ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ নিয়েও দ্বিবিধ মত রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সত্যজিৎ লায়েক বলেন, ‘‘এ নিয়ে দু’টি মত রয়েছে। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে ও আষাঢ়স্য প্রশম দিবসে, অর্থাৎ, আষাঢ়ের শেষ দিনে। যদিও মল্লিনাথের টিকা অনুযায়ী আষাঢ়ের প্রথম দিবসই গ্রহণীয়।’’
অথচ কালিদাস, রবীন্দ্রনাথ-যুগ অতিক্রম করার পরে সেই পয়লা আষাঢ়ের সঙ্গে বাঙালি মানস-যোগ ক্রমশ ছিন্ন হয়েছে। বরং জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে শ্রাবণ অনেকটাই এগিয়ে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে কবি শ্রীজাত বলছেন, ‘‘শ্রাবণ শ্রবণসুন্দর। তাছা়ড়া রবীন্দ্রনাথ এই মাসেই চলে গিয়েছিলেন। তাই বোধহয় শ্রাবণের সঙ্গে বাঙালির এক আজন্ম বিরহ-যোগ।’’ আর যাঁর হাত ধরে, যাঁর শব্দমুখরস্পর্শে ‘মেঘবালিকা’ আজন্ম সঙ্গী বাঙালি পাঠকের, সেই কবি জয় গোস্বামী বলছেন, ‘‘পয়লা আষাঢ় নিয়ে কোনও কবিতা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না ঠিকই। কিন্তু আমি নিশ্চিত পয়লা আষাঢ় নিয়ে নিশ্চয়ই বাংলা কবিতা রয়েছে।’’
বাংলা কবিতা-গানে আষাঢ়-প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে এলেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে আলাদা করে কিন্তু আষাঢ়-শ্রাবণের উল্লেখ নেই। তবলাবাদক পণ্ডিত তন্ময় বসুর কথায়, ‘‘আষাঢ়-শ্রাবণকে আলাদা করে চিহ্নিত করে কোনও রাগ বা কম্পোজিশন তৈরি হয়নি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে সামগ্রিক ভাবে বর্ষা ঋতুকে ধরা হয়েছে।’’ বাঙালিও শেষ পর্যন্ত সেই বর্ষাকেই মনে রেখেছে, পয়লা আষাঢ়কে নয়!
কিন্তু এটাও ঠিক, এই বিস্মৃতি-অনিশ্চয়তা-সংশয়ের মধ্যেও পয়লা আষাঢ় রয়ে গিয়েছে। নিজের মতো করে। কারণ, কিছু দিনের মধ্যে যখন রাস্তা জলমগ্ন হওয়ার ক্ষোভ-বিরক্তি মিলেমিশে যাবে ফেসবুকের বৃষ্টিপ্রবণ কবিতাগুচ্ছের সঙ্গে, যেমন ভাবে শহরের ছাতা বিক্রির ঊর্ধ্বমুখী রেখচিত্রের সঙ্গে মিশে যাবে ‘রেনি-ডে’র ছোট্ট উল্লাস, যেমন ভাবে মেসি-রোনাল্ডো হয়ে রাস্তার জলভর্তি খানাখন্দ বাঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত সাফসুতরো হয়ে অফিসে পৌঁছনোর বিজয়ীর হাসি মিশে যাবে কত মিলিমিটার বৃষ্টি হল, তার নীরস হিসেবের সঙ্গে— সেই সমস্ত বিপরীতমুখী অথচ কী প্রবল ভাবে একাকার হয়ে থাকা ঘটনাপ্রবাহের সূত্রপাত কিন্তু আজই! এ যেন শহরের যে বৃষ্টিপ্রবণ ঘ্রাণ আর কিছু দিনের মধ্যে শহরের পুরো বারান্দা জুড়ে, ছোট্ট অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়তে চলছে, তার শুরুটা এই পয়লা আষাঢ় থেকেই!
সে বৃষ্টি হোক আর না-ই হোক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy