পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকে ‘সাজানো ঘটনা’ অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার আলিপুর আদালত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আলিপুর থানায় হামলাকারী তৃণমূল সমর্থকদের পিঠ বাঁচাতে তাঁরই পুলিশ কী ভাবে পাঁচ ‘নিরীহ’ নাগরিককে ধরে এনে মামলা সাজিয়েছে! ধৃতদের সকলকে এ দিন জামিন দিয়েছে আদালত।
গত শুক্রবার আলিপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত জেলাশাসকের বাংলোর পাশে একটি কুড়ি কাঠা সরকারি জমিতে পূর্তকর্মীরা কাজ করতে গেলে স্থানীয় বিধানচন্দ্র রায় কলোনির বাসিন্দারা বাধা দেন। পুলিশ কয়েক জনকে থানায় নিয়ে এসেছিল। তাদের ছাড়াতে থানায় চড়াও হয়ে ভাঙচুর, তাণ্ডব চালায় কলোনির কিছু লোক। জনতার উন্মত্ত আক্রমণের মুখে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন পুলিশকর্মীরা, কেউ কেউ টেবিলের তলায় আশ্রয় নেন। প্রসঙ্গত, ওই কলোনি কমিটির সভাপতি হলেন দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূলের যুব সম্পাদক প্রতাপ সাহা, পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে যাঁর খ্যাতি।
এবং পুলিশের নিচুতলার অভিযোগ, প্রতাপকে ধরা তো দূরের কথা, থানায় ডেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলে ওসি বহিরাগত পাঁচ জনকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে কুশীলবদের গায়ে আঁচ না-লাগে। ধৃতদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয় নিতান্ত লঘু ধারায়, এমনকী তাদের পুলিশ নিজস্ব হেফাজতেও নিতে চায়নি। আইনজীবী ও পুলিশ মহলের একাংশের ধারণা, ভবিষ্যতে চাপের মুখে আসল অপরাধীরা ধরা পড়লেও যাতে তাদের কড়া শাস্তি না হয় এবং জেল হেফাজতে রাখা যায়, তা মাথায় রেখেই এই সব পদক্ষেপ। উল্লেখ্য, আলিপুর থানার বর্তমান ওসি-ও পুরমন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ বলে পরিচিত। ফলে মন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ নেতাকে গ্রেফতারে থানা কতটা উদ্যোগী হবে, তা নিয়ে আম-পুলিশকর্মীরাই প্রশ্ন তুলেছেন।
এই সব প্রশ্ন, অভিযোগ ও ধারণা যে নেহাত ভিত্তিহীন নয়, এ দিন আদালতের প্রতিক্রিয়ায় তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। পুলিশের জমা দেওয়া কেস-ডায়েরি পড়ে আলিপুর আদালতের মুখ্য বিচারক সঞ্জীব দারুকার পর্যবেক্ষণ, “কেস-ডায়েরিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ নেই। সাক্ষী ও ধৃতদের যে জবানবন্দি পুলিশ নিয়েছে, তাতেও ঘটনার সঙ্গে অভিযুক্তদের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলেনি।” সরকার পক্ষের কৌঁসুলি সৌরীন ঘোষাল ধৃতদের পুনরায় জেল হেফাজতের আর্জি জানালে বিচারকের মন্তব্য, “এই পাঁচ জনকে ঘটনাস্থলে গ্রেফতার করা হয়নি। হামলার সময়ে তাঁরা আলিপুর থানা চত্বরে উপস্থিত ছিলেন, তেমন সিসিটিভি ফুটেজ-ও পুলিশ দেখাতে পারেনি।”
এমতাবস্থায় ধৃতদের সঙ্গে ঘটনার কোনও যোগ তিনি অন্তত খুঁজে পাচ্ছেন না বলে জানিয়ে দেন বিচারক। ফের হেফাজতের আর্জি নাকচ করে তিনি বলেন, “অভিযুক্তদের ইতিমধ্যে তিন দিন জেল হেফাজতে থাকতে হয়েছে। সব বিবেচনার পর আমি আর ওঁদের আটকে রাখতে রাজি নই।”
ধৃত পাঁচ জন শেখ রেজ্জাক, মহম্মদ শাকিল, মহম্মদ পাপ্পু, সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ছোট্টু সাউকে পাঁচশো টাকার জামিনে মুক্তি দেয় আদালত। আলিপুর আদালতের লক-আপ থেকে তাঁরা ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। ২০১৫-র ২ মে ওঁদের ফের আদালতে হাজির হতে হবে। এ দিকে আদালতের নির্দেশ ঘোষণার পরেই আলিপুরের ওসি বুদ্ধদেব কুণ্ডু সরকার পক্ষের কৌঁসুলির সঙ্গে দেখা করেন। সরকারি কৌঁসুলি পরে দাবি করেন, প্রাথমিক তদন্তে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে প্রমাণ মিলেছিল। তদন্ত এখনও চলছে। অন্য কারও জড়িত থাকার প্রমাণ মিললে তাঁদেরও গ্রেফতার করা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ধৃতদের পুলিশি হেফাজত চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সরকারি কৌঁসুলি।
পুলিশ নিজেই জানিয়েছে, পাপ্পু, রেজ্জাক ও শাকিল বন্দর-এলাকার মেটিয়াবুরুজ-রাজাবাগানের বাসিন্দা। সৌমেনের বাড়ি মথুরাপুরে। আর ছোট্টু থাকেন ভবানীপুরের বেলতলা রোডে। পুলিশের দাবি ছিল, আলিপুর থানার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে হামলাকারী হিসেবে ওঁদের চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও পুলিশের সিসিটিভি ফুটেজে ধৃতদের কোনও ছবি মেলেনি বলে শনিবার পাল্টা অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁদের কৌঁসুলি অর্ঘ্য গোস্বামী। ভুয়ো অভিযোগে গ্রেফতারের কথা বলেছিল ওঁদের পরিবারও। এ দিন ছাড়া পাওয়ার পরে শাকিল ও পাপ্পু প্রকাশ্যেই বলেন, “পুলিশ আমাদের ভুলিয়েভালিয়ে থানায় নিয়ে গিয়ে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়েছে। হুমকি দিয়েছে, সংবাদমাধ্যমে মুখ খুললে অন্য মামলাতেও ফাঁসানো হবে। আমরা ভয়ে ভয়ে আছি।”
আলিপুর-কাণ্ডে গত শনিবারেও পুলিশকে বিচারকের তোপের মুখে পড়তে হয়েছিল। থানায় হামলার মতো গুরুতর অপরাধের মামলায় পুলিশ কেন এমপিও (স্বাভাবিক জনজীবন অক্ষুণ্ণ রাখা) আইনের ৯ নম্বর ধারা এবং পিডিপিপি (সরকারি সম্পত্তি রক্ষা) আইনের ৩ নম্বর ধারা প্রয়োগ করেনি, সরকারপক্ষের কৌঁসুলির কাছে তা জানতে চেয়েছিলেন বিচারক। সন্তোষজনক উত্তর না-পেয়ে আদালত বিস্ময়ও প্রকাশ করে। এ দিন অবশ্য তদন্তকারী অফিসার পিডিপিপি আইনের ৩ নম্বর ধারা যুক্ত করার আবেদন জানিয়েছেন।
বস্তুত পুরো ঘটনাক্রমের মধ্যে পুলিশের সাজানো নাটকই ফাঁস হয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একাংশ। পুলিশ সূত্রেও তার সমর্থন মিলছে। জানা যাচ্ছে, ঘটনাস্থলে না-থাকলেও আলিপুর-চেতলার তৃণমূল নেতা প্রতাপবাবুই হলেন থানা-আক্রমণের নেপথ্য নায়ক। শুধু তা-ই নয়, আলিপুর থানার সিসিটিভি ফুটেজ থেকে যে ১৫ জনকে পুলিশ চিহ্নিত করেছে, তাঁদের মধ্যে তৃণমূলের স্থানীয় এক নেত্রী আছেন, যিনি কি না ২০০৯-এ আলিপুর থানায় ভাঙচুরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। শ্যামলা রংয়ের মোটাসোটা এক যুবককেও চিহ্নিত করা হয়েছে, যাঁকে প্রতাপ সাহার ছায়াসঙ্গী বলা যায়।
অথচ রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ে এঁদের কাউকে ছোঁয়ার সাহস পুলিশকর্তারা দেখাতে পারেননি। তা নিয়ে বাহিনীর নিচুতলার ক্ষোভ-অসন্তোষও ধূমায়িত। যার আঁচ পেয়ে তদন্তকারী অফিসার আদালতে সিসিটিভি ফুটেজের একটি ভিডিও জমা দিয়েছেন। আলিপুর থানা সূত্রের খবর, ফুটেজটি দেখলে ১৫ জনকে চিনতে অসুবিধে হবে না। “আমরা চাই, ফুটেজ দেখে হামলাবাজদের ধরার জন্য কোর্ট এ বার আলিপুর থানাকে কড়া নির্দেশ দিক। তাতে অন্তত আমাদের মুখরক্ষা হবে,” মন্তব্য করেন লালবাজারের একটি সূত্র।
এখন কি পুলিশ তাঁর ঘনিষ্ঠদের গ্রেফতার করবে? এ দিন প্রশ্নটি শুনে যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন পুরমন্ত্রী। প্রতাপবাবুর ফোন ‘সুইচড অফ’ ছিল। ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলেও তাঁর নাগাল মেলেনি।
“পুলিশের ভাবমূর্তি রক্ষার স্বার্থেই এটা দরকার। মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি থেকে ফিরলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।” জানাচ্ছেন লালবাজারের এক সূত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy