ছিটমহল হস্তান্তর নিয়ে সব আপত্তি তুলে নিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার।
মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র গত সপ্তাহের শেষ দিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্য সরকার চায় ৬৫ বছর ধরে ঝুলে থাকা বিষয়টির সমাধান হোক। সরকারি সূত্রের খবর চিঠিতে বলা হয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহল বিনিময়ে নীতিগত ভাবে কোনও আপত্তি নেই রাজ্য সরকারের। তবে ছিটমহলের যে অংশ পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হবে, সেখানে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রণয়ন ও পরিকাঠামো উন্নয়নে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। রাজ্য চায় সেই আর্থিক দায়িত্বের পুরোটাই নিক কেন্দ্র।
উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে কাল, বৃহস্পতিবার কোচবিহারের জনসভায় রাজ্য সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্থানীয় প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রীর জনসভার জন্য ছিটমহল লাগোয়া কোনও মাঠ বাছার নির্দেশ এসেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। নেত্রীর জেড প্লাস নিরাপত্তার বহর অক্ষুণ্ণ থাকে, প্রত্যন্ত এলাকায় এমন মাঠ বাছতে ঘাম ছুটে যায় প্রশাসন ও জেলা তৃণমূল নেতৃত্বের। কিন্তু তখনই স্পষ্ট হয়েছিল, জনসভায় ছিটমহল নিয়ে কোনও বড় খবর ঘোষণা করতে চান মমতা। শেষ পর্যন্ত কোচবিহারের প্রত্যন্ত এলাকা ডাকুর হাটকে তাঁর জনসভার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। এখানে তাঁর মঞ্চের শ’দেড়েক মিটার পিছনেই বাংলাদেশি ছিটমহল করলা। তাঁর বক্তৃতা শুনতে যে ছিটমহলের বাসিন্দারাও আসবেন, মমতা তা বিলক্ষণ জানেন। থাকবেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি। ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসন নিয়ে বুধবারই জেলা প্রশাসনের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনাও সেরে ফেলতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী।
লোকসভা নির্বাচনের আগে কোচবিহারের জনসভাতেই মমতা প্রথম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ছিটমহল নিয়ে তিনি অবস্থান বদলাচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তিনি চান বাসিন্দাদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করে ছিটমহল বিনিময় হোক। বাংলাদেশের সাবেক ডেপুটি হাই কমিশনার আবিদা ইসলাম সেপ্টেম্বরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁর কাছেও ছিটমহলবাসীর দুঃখ-দুর্দশার কথা বর্ণনা করেন মমতা। সম্প্রতি নবান্নে বাংলাদেশের সাংসদদের একটি দলের কাছেও মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “অসুখ হলে ডাক্তার-হাসপাতাল নেই, পড়াশোনার স্কুল-কলেজ নেই, থানা-পুলিশ নেই, নাগরিকত্বের পরিচয়টুকুও নেই ৬৫ বছর ধরে এই অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। ভাবা যায়?”
গত সপ্তাহে বিদেশ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্থলসীমান্ত চুক্তির খসড়াটি অনুমোদিত হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের দুই প্রতিনিধি সুগত বসু ও মুমতাজ সংঘমিতা এত দিন বিরোধিতা করে এলেও এই বৈঠকে চুক্তির পক্ষেই সায় দেন। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় তখন বলেন, পুনর্বাসনের সার্বিক আর্থিক দায় কেন্দ্র না-নিলে রাজ্য ছিটমহল চুক্তির বিরোধিতাই করে যাবে। প্রশ্ন উঠেছিল, দলের অবস্থান পরিবর্তনের খবর কি অন্যতম সর্বোচ্চ নেতা মুকুল রায় রাখেন না? তা ছাড়া পাঁচ বছর আগে এই চুক্তির খসড়া রচনার সময়েই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছিল, ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসন প্রকল্পটি রাজ্য প্রশাসন রূপায়ণ করলেও সম্পূর্ণ আর্থিক দায়ভার তারাই নেবে। এ জন্য ৩০৮ কোটি টাকার একটি তহবিলও তৈরি করে রেখেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ছিটমহলবাসীর পুনর্বাসন নিয়ে গত কয়েক বছরে রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে অন্তত সাত বার বৈঠক করে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসাররা। কখনও কখনও কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির জেলাশাসকও সেই বৈঠকে হাজির থেকেছেন। কেন্দ্রীয় অফিসাররা বরাবরই বলেছেন, টাকাকড়ি নিয়ে অসুবিধা হবে না, তাঁরা শুধু চান কোনও বিতর্ক ছাড়াই যেন পুনর্বাসন প্রকল্পটি রূপায়িত হয়। বৈঠকে উপস্থিত অফিসারদের নির্দেশ দেওয়া হয়, সংবাদমাধ্যমের কাছে তাঁরা যেন মুখ না খোলেন। সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’র নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানান, স্থলসীমান্ত চুক্তি বিল সংসদে পাশ হওয়াটা এখন সময়ের অপেক্ষা। আশার আলো দেখছেন দু’দেশের ১৬২টি ছিটমহলের প্রায় ৫৬ হাজার অধিবাসী। ছিটমহল বিনিময় হলে কত সংখ্যক পরিবার ঠিকানা পরিবর্তন করতে চান, সে বিষয়ে সম্প্রতি সমীক্ষা চালায় এই সংগঠন। দীপ্তিমান জানিয়েছেন, বর্তমানে ভারতীয় ছিটমহলের ১৪৯টি পরিবারের ৭৩৪ জন বাসিন্দা ঠিকানা বদলে ভারতের নাগরিকত্ব পেতে চান। তাঁদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশি ছিটমহলের বাসিন্দারা পর্যাপ্ত জমি কোচবিহার প্রশাসনের হাতে দিয়েছেন। প্রয়োজনে আরও জমি দিতে পারেন বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy