মমতার শপথে এক ফ্রেমে নীতীশ কুমার, ফারুক আবদুল্লা, কানিমোলি, লালু প্রসাদ। নয়া সমীকরণের ইঙ্গিত? ছবি: পিটিআই।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের এতগুলি আঞ্চলিক দলকে শেষ কবে এ ভাবে এক মঞ্চে দেখা গিয়েছে, তা নিয়ে জোর আলাপ-আলোচনা রেড রোডে।
ভিভিআইপি অতিথিরা বেশ বিস্ময় নিয়েই নিজেদের মধ্যে তখন কথা বলছেন নক্ষত্র সমাবেশের ব্যাপারে। সেই ভিড়ে লালু প্রসাদ, নীতীশ কুমার, ফারুক আবদুল্লার মতো দীর্ঘ দিনের পোড় খাওয়া রাজনীতিক তথা জাতীয় রাজনীতির দীর্ঘকালীন মহারথীরা যেমন রয়েছেন, তেমনই অখিলেশ যাদব, অরবিন্দ কেজরীবাল, কানিমোলির মতো তরুণ, সম্ভাবনাময়রাও রয়েছেন।
ঘুরেফিরে সবার মুখেই শোনা যাচ্ছিল মমতার অসামান্য আয়োজনের কথা। অনেকেই স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন। জয়ললিতা এর আগের বার যখন শপথ নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে, তখন সেই মঞ্চে কোন কোন দলকে দেখা গিয়েছিল? এমজি রামচন্দ্রনের শপথ অনুষ্ঠানই বা কেমন হয়েছিল? অন্ধ্রে চন্দ্রবাবু নাইডু কি চমক দিতে পেরেছিলেন শপথে? এনটি রামা রাওয়ের আমলেই বা কেমন হয়েছিল শপথ অনুষ্ঠান? গাঁধী ময়দানে নীতীশের শপথ, রামলীলা ময়দানে অরবিন্দ কেজরীবালের শপথ যেমন আলোচনায় উঠে আসছিল, তেমনই উঠে আসছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের আমলে বিহারে কর্পূরী ঠাকুরের ঐতিহাসিক শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কথাও।
আলাপ-আলোচনা যতই হোক, মোটামুটি সকলেই একমত হলেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এ বারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, উল্লেখযোগ্য মুখ্যমন্ত্রীদের শপথ অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে সামনের সারিতেই থাকবে।
কেন সামনের সারিতে থাকবে?
নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মমতার ভিভিআইপি অতিথিরা কেউ সে কথা স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেননি এ দিন। কিন্তু মিডিয়ার মুখোমুখি হতেই অকপটে তাঁরা বলেছেন, জাতীয় রাজনীতিতে ছাপ ফেলতে চলেছে ২৭ মে-র রেড রোড। উস্কে দিয়েছেন জাতীয় স্তরে তৃতীয় বিকল্পের সম্ভাবনা।
মমতার শপথে এ দিন আক্ষরিক অর্থেই কাশ্মীরের প্রতিনিধি যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন কন্যাকুমারীর প্রতিনিধিও। জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা ন্যাশনাল কনফারেন্স নেতা ফারুক আবদুল্লা অনুষ্ঠান মঞ্চে পৌঁছেই আলিঙ্গন করলেন মমতাকে। পাশে তখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব এবং করুণানিধির কন্যা তথা ডিএমকে সাংসদ কানিমোলি। জেডিইউ-এর প্রধান নীতীশ, আরজেডি-র প্রধান লালু, আম আদমি পার্টির প্রধান অরবিন্দ কেজরীবাল, তেলুগু দেশমের প্রতিনিধি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশোক গজপতি রাজু— তাঁরাও হাজির মঞ্চে। এতগুলি প্রবল প্রতাপশালী আঞ্চলিক শক্তি শপথ মঞ্চে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে ছিলেন শুক্রবার। বড় সমীকরণ গঠিত হতে চলেছে, এমন ভাবনা থেকে কেউ আসেননি। এসেছেন রাজনৈতিক সৌজন্যের খাতিরেই। কিন্তু সেই সৌজন্যের রাজনীতিই জাতীয় স্তরে নতুন বৃহত্তর জোটের জল্পনা উস্কে দিয়েছে।
আরও পড়ুন:
সরকারের তরফে এলেন জেটলি-বাবুল, দলের হয়ে ‘তোপ’ দাগলেন অমিত
ফারুক আবদুল্লা সবার আগে সে বিষয়ে মুখ খোলেন শুক্রবার। প্রবীণ কাশ্মীরি নেতা বলেন, ‘‘ফেডারেল ফ্রন্টের সম্ভাবনা সব সময়ই রয়েছে। অখণ্ড ভারতের স্বার্থে সব ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলির একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। এখন দেশের যা পরিস্থিতি, তাতে তৃতীয় বিকল্পের কথা ভাবতেই হবে।’’
ফারুকের মন্তব্যে যে জল্পনা শুরু হয়েছিল, লালু প্রসাদ তা আরও উস্কে দেন। মমতার শপথে যোগ দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাই বিজেপির বিরুদ্ধে, সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি একত্রিত হোক। যখনই দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং দেশের অখণ্ডতা বিপন্ন হয়েছে, তখনই আমরা সবাই হাত মিলিয়ে তাকে রুখে দিয়েছি। এ বারও আমরা সবাই মিলে বসব, আলোচনা করব এবং জাতীয় স্তরে ঐক্য গড়ে তুলব।’’
মমতার শপথে এতজন আঞ্চলিক অধিপতির এক মঞ্চে আসার ঘটনায় তিনটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে।
প্রথমত, প্রমাণিত হয়েছে সৌজন্যের রাজনীতির নামে হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে দেশের প্রায় কোনও ধর্মনিরপেক্ষ আঞ্চলিক দলেরই সমস্যা নেই।
দ্বিতীয়ত, গোটা দেশে বিজেপির দাপট রুখতে আঞ্চলিক দলগুলি তৃতীয় বিকল্প তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। কংগ্রেসের ছাতার তলায় সমবেত হয়ে বিজেপির বিরোধিতা করার বদলে নিজেদের জোট গড়ার বিষয়ে ভাবতে শুরু করেছে তারা।
তৃতীয়ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চাইছে না কোনও আঞ্চলিক দলই। জাতীয় রাজনীতিতে তৃতীয় বিকল্প গড়ে তুলতে হলে তৃণমূলকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয় বলেই মনে করছে দেশের প্রায় সবক’টি প্রভাবশালী অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দল।
এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বিজেপি-কে অবশ্যই চাপে ফেলল। কেন্দ্রীয় সরকারের দুই প্রতিনিধি অরুণ জেটলি এবং বাবুল সুপ্রিয় সৌজন্য রক্ষা করতে এসে দেখে গেলেন, সংসদে কী বিশাল আঞ্চলিক জোটের বিরোধিতার মুখে পড়তে হতে পারে তাঁদের।
এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান কংগ্রেসের জন্যও অশনি সঙ্কেত। বিহারে লালু-নীতীশ-কংগ্রেসের জোট বিজেপি-কে ধরাশায়ী করার পর, কংগ্রেসের তরফে গোটা দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলকে বার্তা দেওয়া চেষ্টা হয়েছিল যে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েই গেরুয়া ঝড় রোখা সম্ভব। মমতার শপথ গ্রহণের মঞ্চ স্পষ্ট করে দিল, বিজেপি বিরোধিতায় কংগ্রেসের হাত ধরাকে অপরিহার্য মনে করছেন না অনেকেই। তৃতীয় বিকল্পের কথা ভাবাও শুরু হয়ে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy