হাসান হায়দার খান। নিজস্ব চিত্র
রাজপুত্তুর গো! দোহারা, লম্বা, মানুষটিকে ঠাকুরদালানে দেখলে কানাকানি ভেসে আসে। কিন্তু শক্তসমর্থ মোড়কে যেন একটি শিশু। ঘুরে ঘুরে বয়সে ছোট বৌদির কাছে লাজুক ভাবে লুচির আবদার করছেন! কিংবা বাড়ির নতুন জামাইকে দেখে আহ্লাদে আটখানা। রাজবাড়ির সদর দরজায় রোশনচৌকিতে সানাই শুরু হলেই শুধু মুখে কথা নেই! সানাইওয়ালাদের কাছে ঘেঁষটে বসে সেই যে মাথা নেড়ে বাজনা শোনা শুরু হবে, বৃদ্ধা মা খেতে ডাকলেও তাঁকে নড়ায় কার সাধ্যি!
দেবীপক্ষে সেই বিস্মৃত সুর নিরন্তর কানে বাজে শোভাবাজারের অলকবাবুর। এমনিতে কানে যন্ত্রটা পরেও নিজের স্ত্রী ছাড়া কারও কথা শুনতে কষ্ট। কিন্তু সানাইয়ের ব্যাপারই আলাদা! তখন তো পুজোর চার দিনের গল্প নয়! মহালয়ারও আগে কৃষ্ণনবমীতে বোধন বসা ইস্তক ঘরদোর জমজমাট। সানাইওয়ালাদেরও তখন থেকেই বরাত। একেবারে বিজয়া দশমীতে ঠাকুরের সঙ্গে গঙ্গায় নৌকোয় বাজিয়ে ছুটি। ‘সোপ্তুমী-ওস্টুমী’তে বাড়ির এক কত্তা বিদগ্ধ সমঝদার হারীতকৃষ্ণ দেব বন্ধুবিজ্ঞানী সত্যেন বসুকে নিয়ে চেয়ার পেতে বসতেন। তাল দিতে দিতে মন দিয়ে সানাই শোনেন তাঁরা।
সে-সব যেন গত জন্মের কথা! তবু সোনু পোড়েলটা বড্ড ধরেছিল এ বারও। ওর জেঠু, দাদু কে না-বাজিয়েছেন এই আসরে। কিন্তু এ বার হল গিয়ে সংযমের পুজো। মনটা হু-হু করলেও শোভাবাজারের অলককৃষ্ণ দেব দৃঢ় স্বরে ‘না’ করে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ‘রায় কার্যকর করার দায়িত্ব পুলিশ-প্রশাসনের’
তাতে কী! অলকবাবুর কানে সানাইয়ের রাগ যে আপনা-আপনি বেজে চলে। আর চোখে ভাসছে, সেই আদরের চিরশিশু ভাই সন্তুর ছবি। কী ভাল গানের গলা ছিল ভাইটির! আঙুরবালা, ইন্দুবালা, বেগম আখতারদের গান— সব ঠোঁটস্থ। কিন্তু হল না কিছুই। সে-যুগে, বড়-বাড়িতেও ‘মাথায় অসুখ’ ছাপ পড়ে গেলে জীবন কী আর সহজ হতো! কেন যে ছেলেটাকে গান শেখাল না কেউ। সানাইপাগল সেই প্রয়াত অনুজ আর স্মৃতির সানাই— দু’জনেই অলকবাবুর পাশে এসে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন: ‘ভিড় সামলে দেব, কিন্তু অঞ্জলি!’
দুর্গাপুরের হস্টেল অ্যাথলেটিক ক্লাবের ‘টুটুবাবু’ও পারতপক্ষে মণ্ডপের পাশে ফাঁকা স্টেজটার দিকে চান না। গোড়ার দিকে অবশ্য প্যান্ডেলের গেটে উঁচুতে নহবত বসত। কিন্তু আসমতসাহেবের চেহারাটা ক্রমশ ভারী হচ্ছিল। মই বেয়ে উপরে উঠতে হাঁসফাঁস। ডিএসপি-র কর্মীদের হস্টেলের নতুন-পুরনো আবাসিকদের পুজোর তিন দশকের মাতব্বর অঞ্জন দাস ওরফে টোটনদাকে আদর করে ‘টুটুবাবু’ বলে ডাকতেন সানাই-শিল্পী আসমত হুসেনই।
২০০২-এ তাঁর অকাল প্রয়াণের বছরেও দুর্গাপুরের এই পুজোর সঙ্গে সমার্থক আসমতসাহেব। তিন দশক আগে প্রথমবার সাজ্জাদ হুসেনের সঙ্গে বাজাতে এসে মায়ায় বাঁধা পড়েন। ‘পুজোয় জলসা হবে না টোটনদা? বিয়েশাদির কিছু খবর আছে?', মার্কাস স্কোয়ারের আস্তানা থেকে আসমতপুত্র বরকতের ফোন পেয়ে অকৃতদার টোটনবাবুর চোখে সে-দিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা। নবমীতে রাতভর সানাইয়ে সবাইকে পাগল করে ভোরের ট্রেন ধরার আগে আসমতসাহেব বলেছিলেন, ‘টুটুবাবু বিয়ে তো করলে না! তোমার বিয়েয় ফ্রিতে বাজাতে আসব, কথা দিচ্ছি!’ ষষ্ঠী থেকে সকাল-সন্ধে বাজানো ছাড়াও অষ্টমীতে চাঁদের হাট পুজোপ্রাঙ্গণ। আরই কলেজের অঙ্ক শিক্ষক অমলেন্দ্র অধিকারীর বাঁশি, দুর্গাদাস কর্মকারের সেতার, ডিভিসিকর্তা বিভাস ভট্টাচার্যের তবলার সঙ্গে আসমতের সানাইয়ে তখন শ্রোতারা বাক্যিহারা। ডাকের সাজের ঠাকুর থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সে-যুগে দুর্গাপুরের এই পুজোর দেমাকই আলাদা।
পুজোর ক’টা দিন ট্রেনি হস্টেলের বি-টু রুমেই আসমতের ঘাঁটি। বরকত তখন ছেলেমানুষ। বাবার সঙ্গে আসত! তবলায় বীরেশ্বর ভৌমিক, ইশতিয়াক আহমেদ, সুরপেটির সিকন্দর, সুরসানাইয়ের ওয়াসি আহমেদরা এক সঙ্গে রেঁধেবেড়ে খেতেন। টুটুবাবুর মত, সানাইয়ের মতো আসমতসাহেবের মাংস রান্নার হাতটাও খাঁটি শিল্পীর! পুজোর সকালে বেনাচিতি বাজারে আসমতের আড্ডা। পুজোর পুরনো মুখগুলো ফাংশনে ডেকে ডেকে খুঁজতেন শিল্পী। কেউ না-এলে তুমুল অভিমান। আবার রাতে প্রায় কেজিটাক দেশি গরুর দুধ আয়েশ করে খেয়ে আসমত বলতেন, এমনটা কোথাও মেলে না। মধ্য কলকাতায় সানাই-পার্টিদের রমরমার দিন গিয়েছে। প্রয়াত সাজ্জাদ হুসেনের বৌমা, বিসমিল্লা খান সাহেবের ছোট মেয়ে আজ়রা বেগম কলুটোলাতেই থাকেন। সে-গলির লোনা-ধরা দেওয়ালে সাজ্জাদ হুসেন শেহনাই পার্টির ফোন নম্বর কষ্ট করে পড়তে হয়। তবে মহম্মদ আলি পার্কের ভিড়টা কখনও ঢুকে পড়ে এ তল্লাটে। আর কয়েক পা এগিয়ে ক্যানিং স্ট্রিটে অগ্নিধ্বস্ত বাগড়ি মার্কেটের পাশেই থম মেরে কলকাতার সানাই-ইতিহাসের গর্বের অধ্যায়। পণ্ডিত রবি শঙ্করের সঙ্গে দূরদর্শনের ‘সিগনেচার টিউন’ স্রষ্টা সানাই-উস্তাদ আলি আহমেদ হুসেন খানের স্মৃতি সেখানে মিশেছে।
শহরের নামজাদা সানাই-শিল্পীরা অনেকেই শেষ জীবনে ‘ওয়তন’ কাশীতে ফিরেছেন। আলিসাহেবের গল্পটা ঠিক উল্টো। ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার’, ‘চাঁদ সামলে রেখো জোছনাকে’ থেকে সুমনের ‘পাগলা সানাই’-এর গানের ফাঁকেফাঁকে কথা বলছে, তাঁর ফুঁ। দেশ-বিদেশের সম্মেলনে বাজিয়ে জীবনভর এই গলিতেই তিনি বার বার ফিরে এসেছেন।
মান্ধাতার আমলের শিয়া ওয়াকফ-বাড়িটার দোতলায় নড়বড়ে লোহার ঘোরানো সিঁড়ি। বাঁ হাতে দশ-বাই-বারো ফুটের একটা ঘর। বছর পাঁচেক আগে জীবনের শেষ পর্বে ডায়ালিসিস নিয়েও টলতে টলতে আলিসাহেব এই সিঁড়ি ভাঙবেন। ছেলেদের, ছাত্রদের ঘোর আপত্তি! তবু শিল্পী অনড়। ‘‘আব্বার পায়ে ধরেও এই ঘর ছাড়াতে পারিনি। বলতেন, আমার কাছে এ হল কাশীর গঙ্গা!’’ পাঁচ ওয়ক্ত নমাজ পড়া নিষ্ঠাবান সানাই-উস্তাদের না কি ওই ঘরেই স্বপ্নে মা সরস্বতী, শিবের সঙ্গে দেখা হতো। ‘‘মা কালীর খোয়াব একবারই দেখেছিলেন আব্বা! তার কিছু দিন বাদেই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ডাক।’’— বলছিলেন, ছোট ছেলে, অধুনা ব্যস্ত শিল্পী হাসান হায়দার খান।
তবলায় সহ-শিল্পী শুভেন চট্টোপাধ্যায়ের মনে আছে, দক্ষিণেশ্বরের সেই পরিবেশে আনন্দীকল্যাণ বাজিয়ে আলিদা ‘আনন্দ হোক, কল্যাণ হোক’ বলে উঠছিলেন। শরতের রোদটা ক্যানিং স্ট্রিটের ঘিঞ্জিতম গলিতেও আলিসাহেব ঠিক চিনে নিতেন। অনুজপ্রতিম শুভেনকে হঠাৎ গাড়ি নিয়ে আসার আবদার। ‘কুমোরটুলি চ’!’ পটুয়াপাড়ায় মাটির গন্ধে কিছু ক্ষণ ঘুরে গঙ্গার ঘাটে যন্ত্রটা বার করে বসলেন। একটু বাজিয়ে ঝালমুড়ি খেয়ে ফের বাড়ি।
‘সানাই নিয়ে গেসলে কোথায় আব্বা?' ‘যিনি আসছেন, তাঁকে স্বাগত করার ছিল! করে এলাম।’— সংক্ষিপ্ত জবাব আলিসাহেবের। দেশবিদেশ থেকে পুজোয় ভবানীপুর নর্দান পার্ক, শিবমন্দির— নানা জায়গায় আলিদার সঙ্গে বাজিয়েছেন শুভেন। ‘‘আলিদা শেখাতেন, একটু ধ্যান করবি! ভগবানের নাম নিবি। তবে তো তবলার ঠেকায় শান্তি, সংযম আসবে! খুব মিস করি ওঁকে।’’ শোভাবাজারের অলকবাবু বলেন, ‘‘সানাই শুনলেই এখন যত পুরনো কথা, মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার দিনটা মনে আসে!’’
এ বার কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতা, ঝাড়গ্রাম থেকে টাটা বাঙালির পুজোমণ্ডপময় শুধু স্মৃতিতে সানাই। আলিসাহেবের নিরাভরণ ঘরখানি বা শূন্য রোশনচৌকি তবু কথা বলে, কে বলে সে নাই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy