জোশীমঠের বিপর্যয়ের ছায়া বঙ্গের শীর্ষ দেশের সেবক-রংপো রেল প্রকল্প পর্যন্ত প্রলম্বিত হওয়ায় উঠছে প্রশ্ন। ছবি: সংগৃহীত।
পূর্ব ও পশ্চিমে দুই অসীম হাত ছড়ানো হিমালয়ের সাম্রাজ্য বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিস্তৃত। সেখানে মনুষ্য উদ্ভাবিত প্রযুক্তির খবরদারি এবং মানুষের তথাকথিত অন্তহীন উন্নয়ন-লিপ্সা কি পর্বতসম্রাটের রোষের কারণ হয়ে উঠছে? উত্তরাখণ্ডের জোশীমঠের বিপর্যয়ের ছায়া বঙ্গের শীর্ষ দেশের সেবক-রংপো রেল প্রকল্প পর্যন্ত প্রলম্বিত হওয়ায় উঠছে এই প্রশ্ন।
উত্তরাখণ্ডের জনপদ জোশীমঠের বিপর্যয়ে হিমালয়ের কোলে-পিঠে লালিত দেশের অন্যান্য জায়গাও আতঙ্কিত। অনেকেরই প্রশ্ন, উন্নয়নের ‘জোয়ার’ কি তবে এ ভাবেই বিপদ ডেকে আনবে? পরিবেশপ্রেমীদের প্রশ্ন, সিকিম যাওয়ার সেবক-রংপো রেলপথ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে না তো?
ওই রেলপথ নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তারা অবশ্য এমন আশঙ্কাকে আমল দিতে নারাজ। তাঁদের বক্তব্যে পরিবেশের থেকে প্রকল্পের স্থায়িত্ব গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সব্যসাচী দে বলেন, ‘‘কোনও প্রকল্প শুরুর আগে তার স্থায়িত্বের বিষয়ে সমীক্ষা করা হয়। করা হয় বাতাস, পরিবেশ এবং ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও।’’ রেলের দাবি, সেবক-রংপো রেলপথ রিখটার স্কেলে ৮.৯ পর্যন্ত কম্পনের তীব্রতা সহ্য করতে পারবে।
সেবক-রংপো ৪৫ কিলোমিটার রেললাইন খরস্রোতা তিস্তা নদী এবং ১০ নম্বর জাতীয় সড়কের পাহাড়ের ঢাল ধরে এগিয়েছে। প্রকল্পে থাকছে ১৪টি সুড়ঙ্গ এবং ২৮টি সেতু। এই রেলপথ নির্মাণ পর্বে বেশ কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত তিন বছরে কাজের সময়ে নানা কারণে ধস নেমে ছ’জন শ্রমিক মারা যান। আহত হয়েছেন অনেকে। যদিও নির্মাণ সংস্থার যুক্তি, ভারী বৃষ্টি এবং কিছু অসাবধানতার জন্য দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রকল্পের ক্ষতি হয়নি।
ওই প্রকল্প কি ধসের মতো ক্ষতির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে? অনেক পরিবেশকর্মীর বক্তব্য, দার্জিলিং, কালিম্পং পাহাড় ভূকম্পপ্রবণ (সিসমিক জ়োন ৪) এলাকার মধ্যে পড়ে। উপরন্তু হিমালয় নবীন ভঙ্গিল পর্বত। সেখানে যে-ভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, পাহাড় ফাটিয়ে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হচ্ছে, তাতে প্রকৃতির ক্ষতি হবেই। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলের সহকারী অধ্যাপক ইন্দ্রজিৎ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘শুধু এই প্রকল্প নয়, দার্জিলিং জেলা জুড়ে যে-ভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কাজ চলছে, তাতেও বিপর্যয়ের আশঙ্কা বাড়ছে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, হিমালয় নবীন ভঙ্গিল পর্বত। পূর্ব হিমালয় নবীনতম। তাই এর গড়ন নরম। কিন্তু এখানে নির্বিচারে বহুতল এবং অন্যান্য নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে। এ দিকে, নেমে যাচ্ছে দার্জিলিঙের জলস্তর। ফলে ভূগর্ভে শূন্যস্থান তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থায় ভূস্তরের উপরে চাপ বেশি পড়লে সেই এলাকা বসে যেতে পারে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তা হলে কি কোনও এলাকার উন্নয়ন হবে না? পরিবেশকর্মীদের বক্তব্য, নিশ্চয়ই হবে। তবে এখন যে-কোনও পরিকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের আগে একটি ‘এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ বা পরিবেশগত সমীক্ষা করা হয়। কিন্তু এ দেশে সরকারি কাজে সেই সমীক্ষা কত দূর ঠিকমতো হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাই সেবক রেলপথ নির্মাণেও উঠছে নানা প্রশ্ন।
ওই রেলপথ নির্মাতা সংস্থার মুখ্য বাস্তুকার মাহিন্দর সিংহের দাবি, সুড়ঙ্গে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তার প্রভাব বাইরে পড়ার আশঙ্কা নেই। ইতিমধ্যে ২৫ কিলোমিটার সুড়ঙ্গ তৈরি হয়ে গিয়েছে। কোনও সমস্যা হয়নি। বর্ষায় কয়েক বার ধস নেমেছে। অনেক পরিবেশবিদ অবশ্য বলছেন, দার্জিলিং, কালিম্পঙে জোরালো বৃষ্টি হয়। মাটি, পাথরের বাঁধুনি যদি আলগা হয়ে থাকে, ধস নামবেই। রেলকর্তাদের দাবি, জোশীমঠ নগরায়ণের চাপে জর্জরিত ছিল। কিন্তু সেবক-রংপো রেলপথ যেখান দিয়ে গিয়েছে, সেখানে জনবসতি নেই।
কিন্তু সেবকের ওই এলাকা যদি ধসে যায়, তা হলে আশপাশের এলাকা রক্ষা পাবে কি, প্রশ্ন থাকছেই।
(সহ প্রতিবেদন: কৌশিক চৌধুরী, শান্তশ্রী মজুমদার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy