—প্রতীকী ছবি
চার বছরের দীপ হালদারের মৃত্যু একটা গোটা পরিবারকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ ক্যানসার যেমন সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে তেমন থাকেও না। দীপের ঠাঁই হয়েছিল এই ১০ শতাংশে। কিন্তু তার বাবা-মায়ের পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়, আর জানলেও একরত্তি সন্তানকে বাঁচানোর জন্য তাঁরা কোনও চেষ্টা করবেন না, তা তো হতে পারে না। তাই দুর্গাপুরের দীপকে নিয়ে সেখানকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ, বেঙ্গালুরুর হাসপাতাল, মুম্বইয়ের হাসপাতাল, কলকাতার হাসপাতাল, আবার বর্ধমানের হাসপাতাল, আবার বেঙ্গালুরুর হাসপাতাল— এ ভাবেই চক্রাকারে ঘুরে গেছে তার পরিবার। ঋণের বোঝা মাথা পর্যন্ত ঢেকে দিয়েছে। দানের ভারে নত হয়েছে অস্তিত্ব। তবু দীপের কষ্ট এতটুকুও কমানো যায়নি। নিরন্তর টানাহেঁচড়ায় ভোগান্তিই বেড়েছে শুধু।
মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত দীপ নভেম্বরের শেষে চলে যায়। গুসকরায় মামাবাড়ির কাছে, যেখানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে, বাবা মনোজ দিনের অনেকটা সময় সেখানে বসে থাকেন। ছেলেটা বড্ড কষ্ট পেয়েছিল। শেষের কিছু দিন শরীরটা নাড়াতে পর্যন্ত পারত না। বিছানাতেই মলমূত্র ত্যাগ, সে ভাবে কিছু খেতেও পারত না। বললেন, ‘‘কথা বলতে পারত না। ঠোঁট ফাঁক করত শুধু। হয়তো কিছু বলতে চাইত আমাদের। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত।’’
দীপের মা রীণা বললেন, ‘‘এখন আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না আমার। এত চেষ্টা করেও ছেলেটাকে বাঁচাতে পারলাম না। বড় ছেলেটার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। দীপের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও যদি চলে যেতে পারতাম, এই অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি হত।’’
মনোজ রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। রীণা বিড়ি বাঁধতেন। সন্তানের অসুস্থতায় দুজনেরই কাজ বন্ধ এক বছরেরও বেশি সময়। জমানো অর্থ শেষ। বড় ছেলেটাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিতে হয়েছে। দুর্গাপুরের বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত না। যেটুকু অর্থ, সবটাই চিকিৎসায় খরচ হত।
রীণা তাই গুসকরায় তাঁর মায়ের কাছে চলে আসেন। কিন্তু সেখানে রুগ্ণ ছেলে নিয়ে থাকার মেয়াদ বাড়তেই পরিবারে অশান্তি শুরু হয়। সন্তান হারানোর পরেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ানি।
দীপ একটি উদাহরণ। কোনও রকম ধারণা, পরিকল্পনা, বাস্তব বুদ্ধি ছাড়া ক্যানসারের সঙ্গে লড়তে গিয়ে এ ভাবেই পায়ের তলার জমি চলে যায় অসংখ্য মানুষের। ক্যানসার রোগীদের সহায়তায় বহু বছর ধরে কাজ করে চলেছেন সমাজকর্মী অনুপ মুখোপাধ্যায়। তিনি বললেন, “আমরা জানি, চিকিৎসার খরচ জোটাতে গিয়ে কত পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। এমনকি দারিদ্রসীমার নীচেও চলে যায়। কিন্তু আমরা যে বিষয়ের মধ্যে আলোচনাটাকে প্রসারিত করি না, তা হল ওই সব পরিবার শুধু অর্থনৈতিক ভাবে ধ্বস্ত হয় তা-ই নয়, সমাজচ্যুতও হয়। যে সমাজের তারা অংশ ছিল এক দিন, সেই সমাজের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়। চিকিৎসা চলাকালীনই লোকজন দূরে সরে যায়। ভয় পায়, যদি নতুন করে আর্থিক সাহায্য চেয়ে বসে।” যেমন, রীণার আক্ষেপ, ছেলের অসুখের শুরুতে যে মানুষজন নিয়মিত যোগাযোগ রাখত, শেষ প্রহরে এসে তারাও মুখ ঘুরিয়েছে।
মুম্বই, বেঙ্গালুরু ঘুরে আসা শিশুকে বর্ধমান ও কলকাতার সরকারি হাসপাতাল বলে দিয়েছিল, রেফার না লেখা থাকলে তারা রোগীকে দেখবে না। তাই যে সময়ে দীপের উপশম চিকিৎসা (প্যালিয়েটিভ কেয়ার) দরকার ছিল, সেই অবস্থায় তার ভগ্ন শরীরটা নিয়ে বাবা-মাকে আবার বেঙ্গালুরু ছুটতে হয়েছে। বাজারে ধার যত বেড়েছে, তত বেড়েছে টানাহেঁচড়ায় শিশুর কষ্টও।
অথচ এ রাজ্যে স্বাস্থ্য খাতে সরকার অর্থ ব্যয় করে না তা নয়। ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে সরকারি হাসপাতালের বহিরঙ্গে তো বটেই, অন্দরেও বহু পরিবর্তন করেছে তৃণমূল সরকার। কিন্তু ভুক্তভোগীরা জানেন, চিকিৎসাকে মানবিক করা যায়নি। সময় যত গড়িয়েছে, ততই দূরদর্শিতা ও সদিচ্ছার অভাবে পরিকাঠামোর পরিবর্তনের অনেকটাই জলে গিয়েছে।
তাই ক্যানসার চিকিৎসার পরিকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে সরকার বড়সড় সাফল্যের দাবি জানানোর পরেও তা শেষ পর্যন্ত কিছু ম্লান মুখের ছবিকেই সামনে আনছে বার বার। পুরোপুরি শহরকেন্দ্রিক পরিষেবা, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শহরে পৌঁছতে না পারার ব্যর্থতা আর তারই পাশাপাশি অসুখটা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব বহু পরিবারকে কার্যত ধ্বংস করে দিচ্ছে। মানুষ জানেন না কোথায়, কার কাছে যাবেন, কী করবেন।
এই মুহূর্তে এসএসকেএমে মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার এবং এনআরএসে সোম ও বুধবার হেল্প ডেস্ক চালায় 'লাইফ বিয়ন্ড ক্যানসার' নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কলকাতার ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ-এ রয়েছে মৃণালিনী ক্যানসার সেন্টার। অধিকর্তা চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বললেন, "বহু গরিব পরিবার, যারা চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে পারে না, তাদের জন্য অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করি আমরা। শিশুর চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাবা-মাকে যাতে ঘটিবাটি বিক্রি না করতে হয়, তা দেখা আমাদের সামাজিক কর্তব্য।"
স্বাস্থ্য দফতরের এক প্রাক্তন শীর্ষ কর্তার মতে, “বিচ্ছিন্ন ভাবে হলে চলবে না। জেলা স্তর থেকে শুরু করে শহরের নামী মেডিক্যাল কলেজগুলি পর্যন্ত সমস্ত স্তরে আরও বেশি করে ‘হেল্প ডেস্ক' চালুর ব্যবস্থা, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে কাজে লাগানো, তাদের সঙ্গে প্রকল্প শুরু করা, কোথায় গেলে কী চিকিৎসা পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে দুরদর্শন, রেডিয়োর মাধ্যমে প্রচার ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে হবে।" তিনি বলেন, "এ জন্য সরকারকে বাড়তি আর্থিক বোঝা বইতে হবে না। কিন্তু এ গুলো করার জন্য যে সদিচ্ছা দরকার, তারই অভাব। তাই কেমোথেরাপির ওষুধ ফ্রি-তে মিললেও বাকি ব্যবস্থার দৈন্যে সবটাই এলোমেলো হয়ে যায়। শীর্ষ স্তর থেকে এটা বুঝতে হবে যে খয়রাতির ব্যবস্থা নয়, করদাতাদের অর্থের বিনিময়ে গড়ে ওঠা পরিকাঠামো যাতে ঠিক হাতে পৌঁছয়, তা নিশ্চিত করাই আসল কাজ।”
কিন্তু প্রশ্ন হল, তা হবে কবে? আর কত আকাশ, নুসরতকে সেই ‘সুদিন' দেখার জন্য অনন্ত অপেক্ষা করতে হবে? দীপ হালদারের মতো আর কত শিশু অন্তিম পর্যায়ে সামান্য চিকিৎসাটুকুও পাবে না? প্রশ্ন সহজ হলেও উত্তর অজানা। (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy