জীবন তো প্রবহমান। তাই পথ চলার জন্য বিষাদের আঁধার সরিয়ে আলোর রেখা দেখাও খুব জরুরি।
বিষ! বিষ!
একটি গোটা বছরকে বোঝাতে এ বার এটুকুই হয়তো যথেষ্ট। আমরা জানি, সব বছর সমান যায় না। কখনও প্রাপ্তির খাতা তৃপ্তি দেয়। কখনও বা মনে হয়, না-পাওয়ার পাল্লা ভারী।
কিন্তু এমন সর্বগ্রাসী আতঙ্কে, এমন নিঃস্ব করে দেওয়া যন্ত্রণায় আগে এ ভাবে দগ্ধ হতে হয়নি। এটা আক্ষরিক অর্থেই এক কঠোর জীবন-সংগ্রাম। এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়নি কোনও দিন। ২০২০ তাই অভিশপ্ত বছর হয়ে কালের ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিল।
আরও পড়ুন: বিষ সাল বাদ
একইসঙ্গে আবার এই পরিস্থিতি আমাদেরও বদলে দিল অনেক ভাবে। বদল ঘটেছে আমাদের অভ্যাসে। বদল এসেছে ব্যক্তিগত, সাংসারিক, সামাজিক জীবনচর্যায়। শুধু মুখে মাস্ক পরা বা হাতে স্যানিটাইজার মাখার অভ্যাস তার কাছে হয়তো কিছুই নয়। আমরা বদলে যেতে শিখেছি অন্তরেও।
২০২০ আমাদের শিখিয়েছে নিজের সঙ্গে একা থাকতে! স্বেচ্ছাবন্দিত্ব মানিয়ে নেওয়ার সহনশীলতা শিখে নিতে হয়েছে আমাদের। আর অর্জন করা গিয়েছে নিজের সংসারে সকল কাজের কাজি হয়ে ওঠার জরুরি শিক্ষাও। কাপড় কাচা, বাসন মাজা, রান্না কিংবা ঘর মোছা যে একমাত্র বাড়ির মেয়েদের বা কাজের লোকেদের জন্য নির্দিষ্ট কর্তব্য নয়, বহু পুরুষ সেই বোধে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। বঙ্গজীবনে এগুলি কিন্তু বড় কম কথা নয়! ‘সৌজন্য’ এই বিষের বছর।
আরও পড়ুন: করোনা আবহে অন্য যাপন, ঝড়ের চিহ্ন থেকে যাবে আরও কিছুদিন
কোভিডের কালো ছায়া অবশ্যই বিশ্বব্যাপী। বাংলা তার অংশমাত্র। তবে নিজের শরীরে আঘাত লাগলে তার কষ্ট যে সবচেয়ে নিদারুণ! আর শুধু ব্যাধিই তো নয়, পাশাপাশি এখানে ঘটেছে ‘আমপান’ ঝড়ের মতো এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও। ফেলে আসা বছরটি সব রকম ক্ষত নিয়ে আমাদের নিজস্ব বেদনায় বড় বেশি ভরা।
প্রায় গোটা একটি বছর পেরিয়েও করোনা-মুক্ত নতুন প্রভাত আমরা কাল দেখতে পারব না। অপেক্ষা আরও কত দিনের, সেই অনিশ্চয়তা জিইয়ে রেখেই বলতে হবে, ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’!
তবে সেই কথা বলার আগে প্রতি মুহূর্তে মনে পড়বে তাঁদের, যাঁরা এই মারণব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে হেরে গেলেন। আমাদের পাড়ায়, পল্লিতে, শহরে, গ্রামে, সামাজিক পরিসরে চেনা-অচেনা সেই বিপুল সংখ্যক মানুষের না-থাকা ২০২০-কে শূন্যতায় পূর্ণ করেছে। এঁদের মধ্যেই আছেন কোভিড-যোদ্ধা বহু চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সমাজসেবী, রাজনীতিক।
ঘটনাচক্রে কোভিডে আক্রান্ত হয়েই প্রথমে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বাঙালির দুই পরম অহঙ্কার— প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘ চিকিৎসা তাঁদের শেষ পর্যন্ত জীবনের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেনি।এই দুই প্রয়াণে বাঙালি দীনতর। দেশও।
বস্তুত, বিয়োগের তালিকা এ বার অতি দীর্ঘ। প্রয়াণ সর্বদাই বেদনার। এই বছর তারও যেন বাড়বাড়ন্ত! নানা ক্ষেত্রে নিজেদের কাজের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে ওঠা অনেক
বাঙালির জীবনাবসান হয়েছে এই কালো বছরেই।
কিন্তু জীবন তো প্রবহমান। তাই পথ চলার জন্য বিষাদের আঁধার সরিয়ে আলোর রেখা দেখাও খুব জরুরি। আগে তাই সে দিকে চোখ ফেরানো যাক।
নির্মোহ সত্য হল, বিজ্ঞানের ক্ষেত্র ছাড়া বাঙালির সাফল্যের পুঁজিতে গত বারের মতো এ বারেও বেশ টান! সাহিত্য-সংস্কৃতি-সিনেমা-খেলাধুলো এমনকি রাজনীতিতেও নতুন কোনও উদ্ভাস নজরে পড়ে না। যেখানে যা আছে, তা হয় গতানুগতিক অথবা অবনমনের ইঙ্গিতবাহী। আকাল যেন সর্বাঙ্গে!
বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে দেশের সর্বোচ্চ শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারে সম্মানিতদের ছ’জন অবশ্য বঙ্গ সন্তান। আর এক জন ওড়িশার কন্যা, তবে এখন বাংলার বধূ।
কলকাতায় স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের গণিত শিক্ষক ভাটনগর-জয়ী রজতশুভ্র হাজরার কাজ সম্ভাব্যতত্ত্ব নিয়ে। তিনি এমন একটি মডিউল তৈরি করেছেন, রোগের সম্ভাব্য সংক্রমণের ক্ষেত্রেও যার প্রয়োগ সম্ভব। করোনা-সংক্রমণে কম্পমান সময়ে বিষয়টি আরও অর্থবহ। কোভিড সূত্রেই প্রাসঙ্গিক উল্লেখ থাক আর এক বঙ্গতনয়া চন্দ্রা দত্তের। অক্সফোর্ডে কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণায় যুক্ত তিনি।
ভাটনগর-এ সম্মানিত ভূতত্ত্বের দুই বাঙালি অধ্যাপক খড়্গপুর আইআইটি-র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় এবং মুম্বই আইআইটি-র সূর্যেন্দু দত্ত। অভিজিৎবাবুর গবেষণার সূত্র ধরে ১০০ দিনের কাজে এবং জলশক্তি মিশনে ভূগর্ভে জলের ভাণ্ডার পুনর্সঞ্চার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
অন্য ভাটনগর-প্রাপকেরা হলেন, লিক্যুইড ক্রিস্টাল নিয়ে গবেষণারত হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক সুরজিৎ ধাড়া, অর্থকরী ফসলের পরজীবী সংক্রমণ নিয়ে কাজ করা হায়দরাবাদেরই সেন্টার ফর ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং অ্যান্ড ডায়গনস্টিকের গবেষক শুভদীপ চট্টোপাধ্যায়, ন্যানোসায়েন্স-গবেষণায় যুক্ত ভাবা পরমাণু কেন্দ্রের বিজ্ঞানী কিংশুক দাশগুপ্ত এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর রসায়নের শিক্ষিকা, বাংলার বধূ জ্যোতির্ময়ী দাশ।
এ ছাড়াও ব্রহ্মাণ্ডে আলোর উৎস সন্ধানে নতুন দিশার হদিশ দিয়েছেন পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের বিজ্ঞানী কনক সাহা। চারপাশে এত অন্ধকারের মধ্যে এই আলোর পথযাত্রীরা বাঙালির জন্য ২০২০-কে অনেকখানি উজ্জ্বল করে রাখলেন।
নতুন বছর, ভোটের বছর। তার আগে রাজনীতির চনমনে হয়ে ওঠা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু তাতে মোটের উপর কী পাওয়া গেল? হিংসা-দ্বেষ-কুৎসা-লোভ-ক্ষমতা এবং ব্যক্তিগত চাহিদার কিছু নির্লজ্জ প্রকাশ!
আর এই আবহেই দলবদলের রাজনীতি করে বছরশেষে ‘খবর’-এর শিরোনাম জুড়ে রইলেন সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যাওয়া শুভেন্দু অধিকারী। ২০২১-এ তাঁর জন্য কী অপেক্ষা করছে, বলবে সময়। আগামী নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপি-র ‘মুখ’ হয়ে ওঠার গুঞ্জনে বছরভর থেকে গেলেন ‘দাদা’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মুখে অবশ্য কেউ কিছুই বলেননি। তবে তাঁর নতুন কোনও ইনিংস আদৌ শুরু হবে কিনা, সেটাও বোঝা যাবে সময়ে।
রাজনীতির মঞ্চে আরও এক জন এ বার পাদপ্রদীপের আলো অনেকটা টেনে নিয়েছেন। তিনি তৃণমূলের ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ধাক্কার পরেই এই পেশাদারকে ডেকে এনেছিল তৃণমূল। এই বছরে তিনি ওই দলে যে কোনও নেতার থেকে বেশি ‘প্রভাবশালী’ এবং বিতর্কিত হয়ে উঠেছেন বললে হয়তো খুব ভুল হবে না। একুশের নির্বাচন তাঁর কাছেও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
নিন্দা-স্তুতি যে যা-ই করুন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া বাংলা থেকে কোনও দলের কোনও নেতা জাতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে মান্যতা আদায় করে নিতে পারেননি। নির্বাচনে বাংলার সেই মুখ্যমন্ত্রীর মোকাবিলায় বড় বড় অ-বঙ্গভাষী বিজেপি নেতাদের ভিড় বাড়ছে এখানে। আর তারই অনুষঙ্গে জাগিয়ে তোলা হচ্ছে বাঙালির ‘জাত্যভিমান’। রাজনীতিতে এই ধারাটিও এবারের সংযোজন।
খেলার মাঠে বাঙালি চিরকাল লড়েছে মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল হয়ে। ২০২০-তে সেই ঐতিহ্যের পরিচয়টাও কার্যত মুছে গেল! কর্পোরেট কালচারের সৌজন্যে মোহনবাগান এখন এটিকে-মোহনবাগান, আর ইস্টবেঙ্গল হয়ে গিয়েছে এসসি-ইস্টবেঙ্গল। এ বারও অবশ্য আই লিগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ‘নতুন’ মোহনবাগান। এই নিয়ে দ্বিতীয় বার।
টেনিসে প্রথম ‘দ্রোণাচার্য’ হলেন কলকাতার নরেশ কুমার। তিনি ভারতের নন প্লেয়িং ক্যাপ্টন থাকার সময়ে উত্থান হয়েছিল লিয়েন্ডার পেজের।
করোনার জেরে বদলে গিয়েছে বিনোদন জগতের হিসেবনিকাশ। কলকাতার চলচ্চিত্র উৎসব এ বার হয়নি। রোগের প্রকোপে ধাক্কা এসেছে শুটিংয়েও। টলিউড, টেলিউড সবাই ভুক্তভোগী। করোনার জন্য দুর্গাপুজোর জৌলুস এ বছর কম ছিল। পুজোর পরে গানের জলসাও বন্ধ। ফলে গানের শিল্পীরাও চাপে। সব মিলিয়ে বিনোদনের সব ক্ষেত্রেই এ বার মন খারাপের ছবি।
বিষাদময়তা আরও বাড়িয়ে দেয় এ বছরের মৃত্যু-মিছিল। একের পর এক চলে যাওয়া। বার্ধক্যের কাছে হার মেনে প্রয়াত হয়েছেন নবতিপর নৃত্যশিল্পী অমলাশঙ্কর। বাঙালির এই বছরকে ঘা দিয়েছে, ফুটবলের দুই দিকপাল ও মাঠের সতীর্থ প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (পিকে) এবং চুনী গোস্বামীর প্রয়াণ। রাজনীতির ময়দানে দীর্ঘদিন খেলে এই বছরেই প্রয়াত হয়েছেন সোমেন মিত্র। প্রয়াত সিপিএমের শ্যামল চক্রবর্তী, বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার সুকুমার হাঁসদা-সহ বিভিন্ন দলের আরও কয়েক জন।
হারানোর তালিকায় স্মরণে থাকবেন প্রাবন্ধিক সুধীর চক্রবর্তী, সঙ্গীতশিল্পী পূর্বা দাম ও বাণী ঠাকুর, অভিনেতা তাপস পাল, সন্তু মুখোপাধ্যায় ও মনু মুখোপাধ্যায়, গায়ক-অভিনেতা শক্তি ঠাকুর, চিত্র পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়, নাট্য পরিচালক উষা গঙ্গোপাধ্যায়, ফ্যাশন ডিজাইনার শর্বরী দত্ত প্রমুখ।
কালচক্র পিছনে ঘোরে না। যাহা যায়, তাহা যায়! এগিয়ে চলার লড়াই তবু চলছে, চলবে। কুড়ি কুড়ি বছরের পার নতুন ভোর আসার সেই প্রত্যাশা নিয়ে স্বাগত ২০২১।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy