কালো চশমা। নীল কুর্তা। কালো লেগিংস। এলোমেলো হয়ে রয়েছে খোলা চুল। না রয়েছে চড়া মেকআপ, না চোখধাঁধানো গয়না।
তিনি গৌরী স্প্র্যাট। দেশের একটি নামী স্যালোঁর কর্ণধার। কিন্তু নতুন পরিচয়, বলিউড তারকা আমির খানের প্রেমিকা। আমির নতুন প্রেমিকার কথা জানানোর পর থেকে চর্চায় শুধুই তিনি। তবে ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’-এর প্রেয়সী হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করার তাড়না নেই তাঁর সাজে। গোটা দেশের চোখ যখন গৌরীর দিকে, তিনি কিন্তু সেই আলগোছে, সাদামাঠা সাজেই দেখা দিয়েছেন। সাধারণত বলিউড বললে যে সব কৃত্রিম চাকচিক্যের কথা মনে পড়ে অধিকাংশের, সে সবের কিছুই যেন নেই গৌরীর চেহারায়।

আমিরের প্রেমিকা গৌরী স্প্র্যাট বেঙ্গালুরুর এক নামী স্যালোঁর কর্ণধার। ছবি: সংগৃহীত।
ভক্ত থেকে নিন্দক সকলের মনে প্রশ্ন, রিনা দত্ত, কিরণ রাওয়ের পর এমন কোন নারীর প্রেমে পড়লেন অভিনেতা! হয়তো কারও কারও উদ্দেশ্য ছিল চরিত্রহননের। কিন্তু শেষমেশ গৌরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন বহু জনে। ফলে চর্চায় এখন আমিরের প্রেমিকা গৌরীর সৌন্দর্যই।
বিনোদন জগৎ তো বটেই, অন্যত্রও যেন সাজ বলতে এখন চাকচিক্যের আধিক্য বেশি। কেউ অস্ত্রোপচার করান, কেউ করেন বিশেষ ধরনের মেকআপ। আমিরের প্রাক্তন স্ত্রী রিনা এবং কিরণও তেমন সাজতেন না কখনও। তবে তাঁদের সেই আলগা সাজকে এক সময়ে কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু গৌরীর ক্ষেত্রে জুটল প্রশংসা। সমাজমাধ্যম প্রায় মুগ্ধ এখন তাঁর রূপ নিয়ে। আর তা থেকেই কিছু প্রশ্ন উঠছে। তবে কি সৌন্দর্য এবং সাজের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে? সে প্রশ্ন পৌঁছোল টলিপাড়াতেও।
আরও পড়ুন:
সাদামাঠা সাজেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বাংলার অভিনেত্রী শোলাঙ্কি রায়, ইশা সাহার মতো নায়িকারা। কিন্তু তাঁরা কি মনে করেন, সৌন্দর্যের সংজ্ঞা আসলে বদলাচ্ছে? দু’জনের মতেই, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আসলে তত সহজে পাল্টায় না। সময়ে সময়ে নিজেদের মতো করে নিজেদের বক্তব্যকে ভেঙে-গুঁড়িয়ে পাল্টে নেন অধিকাংশে। আজ যদিও বা গৌরীর সাদামাঠা সাজ পছন্দ হয়, কালই মেকআপ ছাড়া নায়িকাদের দেখলে হাজার খুঁত নজরে পড়বে তাঁদের। শোলাঙ্কির কথায়, ‘‘এখনও স্ত্রী হিসেবে ফর্সা নারীদেরই খোঁজে অধিকাংশ মানুষ। ফর্সা মেয়েকে কালো মেকআপ দিয়ে কালো মেয়ের অভিনয় করানো হয়। আর মানুষ সেটাই মেনে নেয়। তা হলে আর বদল কোথায় ঘটল? আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় গৌরী স্প্র্যাটের ছবি ভাইরাল হয়েছে বলে এত প্রশংসা, কাল অন্য কারও ছবি প্রকাশ্যে এলে নিন্দাও হতে পারে। আর যদি সত্যিই পাল্টাত, তা হলে চারদিকে বোটক্স, সার্জারির ক্লিনিকগুলির এত রমরমা থাকত না। আর যে মহিলারা নিজেদের চেহারা নিয়ে খুশি নন, তাঁদেরকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে এই সমাজই। এক নারীকে অন্য নারীর সঙ্গে তুলনা করতে বাধ্য করা হয়েছে। নিজেকে ‘সুন্দর’ মনে করতে পারেন না তাঁরা। সে দিন বদল আসবে, যে দিন আমরা সবাই নিজেদের সুন্দর বলব। তা কেবল চেহারার জন্য নয়। বুদ্ধিমত্তা, সাহস, মনের জন্যও।’’

‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’-এর প্রেয়সী হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করার তাড়না নেই গৌরীর সাজে। ছবি: সংগৃহীত।
ইশার মতও খানিকটা শোলাঙ্কির মতোই। অভিনেত্রী বললেন, ‘‘গৌরী স্প্র্যাটের সৌন্দর্য নিয়ে প্রশংসা হচ্ছে, তা তো ভাল ব্যাপার। কিন্তু কেবল তো প্রশংসাতেই আটকে থাকে না মানুষ। আবার কখনও ওঁর সাজের খামতি চোখে পড়লে ছেড়ে কথা বলবে না কেউ। আসলে আমরা, মানবজাতি খুবই দু’মুখো। আমার চেনাজানা বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী মেকআপ ছাড়া বেরিয়ে গালমন্দ শুনেছেন। আমার মেকআপ ছাড়া একটা ছবি প্রকাশ্যে এসেছিল এক বার। সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভরে ভরে সকলের বক্তব্য, তাঁরা নাকি চোখের পাতা দেখেই বুঝতে পারছেন, সেটি নকল। অর্থাৎ, কারও সাজ বা সৌন্দর্য, যা-ই হোক, এত খুঁটিয়ে দেখা, নিজেদের মনগড়া কাহিনি বানিয়ে তা নিয়ে নিন্দা করা, এ সব বন্ধ হবে না। তাই বদলের আশা আপাতত স্থগিত থাক। আর যদি কেউ মেকআপ করে নিজেকে সুন্দর বলে মনে করেন, তাতেই তিনি সুন্দর। যদি কেউ না সেজে ভাল থাকেন, তিনি সে ভাবেই সুন্দর।’’
সমাজের দাবিদাওয়ায় কোনও বদলের আশা দেখতে পাচ্ছেন না অভিনেতা অর্জুন চক্রবর্তীও। তাঁর কথায়, ‘‘সৌন্দর্যের মাপকাঠি আসলে তো কিছু হওয়ার কথা নয়। যিনি দেখছেন তাঁর চোখে যা সুন্দর, তা-ই সৌন্দর্যের ধারণা হোক তাঁর কাছে। কিন্তু তা আসলে হয় না। সমাজের তরফে চাপিয়ে দেওয়াই হয়। সেটাই ঠিক নয়।’’

'দাদার কীর্তি'তে দেবশ্রী রায়ের সাদামাঠা সাজ নজরকাড়া। ছবি: সংগৃহীত।
৮০-৯০ দশকের বাংলা ছবিতে সাজের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছিলেন দেবশ্রী রায়। টাঙাইল অথবা ছাপা শাড়ি। একটি বিনুনি অথবা খোঁপা। হালকা রূপটান। এ ভাবেই ক্যামেরার সামনে আসতেন তিনি। এক দিকে, যখন সেই সময়ে বাংলা এবং হিন্দি ছবিতে চকমকে পোশাকের প্রচলন বেড়েছে, অন্য দিকে দেবশ্রী রায়, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো নায়িকাদের সাজে ঘরোয়া ভাব প্রকাশ পেয়েছে। আনন্দবাজার ডট কমকে অভিনেত্রী বললেন, ‘‘তখন তো ডিজ়াইনারদের অত পসার ছিল না, তাই নিজেরাই ব্লাউজ় ডিজাইন করে সে সব পরতাম। ক্যামেরার সামনে হোক বা অন্যত্র, দেবশ্রী রায়কে কোনও দিন কেউ অতিরঞ্জিত সাজে দেখেনি। তখনকার ছবিতে যে খুব বেশি মেকআপ বা ভারী সাজগোজ হত, তা কিন্তু সব ক্ষেত্রে সত্যি নয়। নিজেরা সাজলে অবশ্য অন্য বিষয়। বরং আমি তো দেখছি মানুষ অনেক বেশি খুঁতখুঁতে হয়ে উঠেছে এখন। একাধিক প্রতিষ্ঠিত নায়িকা নিজেদের শরীরে ছুরি-কাঁচি চালাচ্ছেন। কেউ নাক বদলে ফেলছেন, কেউ আবার ঠোঁট। মানুষ তো তাঁদের আগের রূপেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজেদেরকেই সম্ভবত মেনে নেননি তাঁরা।’’ ফলে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা নিয়ে নানা ধারণা আগেও ছিল, এখনও আছে। এমনই বক্তব্য দেবশ্রীর। এক অর্থে তারই সঙ্গে আছেন তরুণ প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সমাজ বদলে গিয়েছে বলে বিশেষ আশাপ্রকাশ করছেন না কেউই।