Advertisement
E-Paper

সুপ্রিম কোর্টে বদলের পরে আর্জির চিন্তা

বর্তমান প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না ১৩ মে অবসর নিচ্ছেন। রাজ্য সরকার বা চাকরিহারাদের পক্ষ থেকে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি দায়ের হলে, তার পরেই হবে বলে আইনজীবীরা মনে করছেন।

মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই প্রতিবাদ মিছিলে চাকরিহারা এক শিক্ষিকা। শনিবার দুপুরে মেদিনীপুর শহরে।

মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই প্রতিবাদ মিছিলে চাকরিহারা এক শিক্ষিকা। শনিবার দুপুরে মেদিনীপুর শহরে। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:৫২
Share
Save

নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পুনর্বিবেচনার আর্জি (রিভিউ পিটিশন) নিয়ে রাজ্য সরকারের অন্দরমহলে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। অন্য দিকে, প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার বেঞ্চের রায়ে যাঁরা ‘নির্দোষ’ বা ‘আনটেন্টেড’ হয়েও চাকরি হারিয়েছেন, তাঁরাও সুপ্রিম কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। সূত্রের খবর, রাজ্য সরকার সে ক্ষেত্রে এই ‘নির্দোষ’ চাকরিহারাদের আর্জিকে সমর্থন জানাতে পারে।

তাৎপর্যপূর্ণ হল, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না ১৩ মে অবসর নিচ্ছেন। রাজ্য সরকার বা চাকরিহারাদের পক্ষ থেকে রায় পুনর্বিবেচনার আর্জি দায়ের হলে, তার পরেই হবে বলে আইনজীবীরা মনে করছেন। কারণ, বর্তমান প্রধান বিচারপতির আমলেই তাঁর রায়ের পুনর্বিবেচনার আর্জিতে কোনও সুরাহা মেলার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর চাকরি খারিজ হয়ে গিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের দু’টি স্পষ্ট শ্রেণিতে ভাগ করেছে। একটি শ্রেণি হল ‘দাগি’ বা ‘টেন্টেড’। আর একটি গোষ্ঠী ‘নির্দোষ’ বা ‘আনটেন্টেড’। এই মামলার সঙ্গে যুক্ত আইনজীবীরা মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই ভেদাভেদ গুলিয়ে দিয়ে সবাইকে ‘বঞ্চিত’ তকমা দিতে চাইছেন। বাস্তব হল, সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে স্পষ্ট ভাষায় গোটা নিয়োগ ব্যবস্থায় অনিয়মের (সিস্টেমেটিক ইরেগুলারিটিজ়) দিকে আঙুল তুলেছে। কিন্তু মনে করা হচ্ছে, তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্ব তা ধামাচাপা দিয়ে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত কোনও অস্থায়ী ব্যবস্থা তৈরি করতে চাইবেন। যাতে রাজনৈতিক ভাবে এর খেসারত দিতে না হয়।

সুপ্রিম কোর্টের মামলায় চাকরিহারা নির্দোষ শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের এক আইনজীবী বলেন, ‘‘কেন গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে দিতে হল, সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে তা স্পষ্ট ভাষায় ব্যাখ্যা করেছে। যেখানে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যবস্থাতেই অনিয়ম থাকে, সেখানে সব সময়ই আদালত গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের পথে হাঁটে। যেখানে কিছু প্রার্থী দুর্নীতির পথে চাকরি পান, সেখানে শুধু দাগিদের চাকরি যায়। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে বলেই সকলের চাকরি খারিজ হয়েছে। প্রশাসনিক দুর্নীতিরই খেসারত নির্দোষ চাকরিরতদের দিতে হচ্ছে।’’

সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, স্কুল সার্ভিস কমিশন স্বশাসিত সংস্থা। সেখানে রাজ্য সরকার মাথা গলায় না। সুপ্রিম কোর্টে নির্দোষ চাকরিহারাদের আইনজীবীদের বক্তব্য, শীর্ষ আদালত স্কুল সার্ভিস কমিশনের পাশাপাশি রাজ্যের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের দিকেও আঙুল তুলেছে। নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষক এবং তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণির কর্মী হিসেবে নিয়োগের জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশন যত জনের নাম সুপারিশ করেছে, রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ তার থেকে বেশি জনকে নিয়োগ করেছে। মোট ২৫,৭৩৫ জনকে রাজ্যের মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ নিয়োগপত্র দিয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ২,৩৫৫ জনের নাম স্কুল সার্ভিস কমিশন সুপারিশই করেনি।

নবম-দশমের শিক্ষক হিসেবে কমিশন ১১,৪২৫ জনের নাম সুপারিশ করেছিল। মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ সেই জায়গায় ১২,৯৪৬ জন বা অতিরিক্ত ১,০৭১ জনকে নিয়োগপত্র দিয়েছিল। একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষক পদেও সুপারিশের থেকে অতিরিক্ত ১৯৯ জন, গ্রুপ সি পদে অতিরিক্ত ৪১৬ জন, গ্রুপ ডি পদে অতিরিক্ত ৬৬৯ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছিল। আদালতে পর্ষদ বলেছে, তারা সুপারিশ মেনেই নিয়োগপত্র দিয়েছে। কমিশন তার বিরোধিতা করে বলেছে, তারা ওই সব অতিরিক্ত নিয়োগের সুপারিশ করেনি। অনেক পরে রাজ্যের দুই সংস্থা এক অবস্থানে আসার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার আগেই গোটা ব্যবস্থার অনিয়ম স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।

চাকরিরত শিক্ষকদের হয়ে সুপ্রিম কোর্টের মামলার সঙ্গে যুক্ত এক আইনজীবী বলেন, রাজ্য সরকার গোড়াতেই সুপ্রিম কোর্টে বলেছিল, এই মামলায় ব্যাপক দুর্নীতি (ওয়াইডস্প্রেড) হয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন সুপ্রিম কোর্টে মেনে নিয়েছে, ১,৪৯৮ জনকে প্যানেলের বাইরে থেকে বেআইনি ভাবে নিয়োগ করা হয়েছে। ৯২৬ জনের মেধাতালিকায় নাম শেষের দিক থেকে প্রথম দিকে নিয়ে আসা হয়েছে। ৪,০৯১ জনের ওএমআর শিটে কারচুপি থাকলেও তাঁদের নাম নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। এদের মধ্যে ২৩৯ জনের নাম হয় মেধাতালিকায় শেষ থেকে প্রথমে নিয়ে আসা হয়েছে অথবা তাদের নাম প্যানেলেই ছিল না। এখান থেকেই স্পষ্ট গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ছেলেখেলা হয়েছে। আর সেই কারণেই সুপ্রিম কোর্ট নির্দোষদের বেতন ফেরত দিতে হবে না বলে সুরাহা দিলেও গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

মামলার সঙ্গে যুক্ত এক প্রবীণ আইনজীবী বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতির রায়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, তথ্যনির্ভর তদন্তে গোটা ব্যবস্থার অনিয়ম উঠে এলে, যেমন জালিয়াতি বা প্রতারণা, তা হলে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। তার ফল হল সমস্ত নিয়োগ বাতিল। রায়ে এ কথাও বলা হয়েছে, নির্দোষ প্রার্থীদের অসুবিধা হলেও যখন গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বড় মাপের এবং গভীর কারচুপির প্রমাণ মেলে, তখন নির্বাচন প্রক্রিয়ার পবিত্রতা রক্ষা করাও জরুরি।’’ ওই আইনজীবীর যুক্তি, সুপ্রিম কোর্ট গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কারচুপি নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকলে তার দায় রাজ্য সরকারকে নিতে হবে। তা ছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের এক নেতা আগেই মন্তব্য করেছেন, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় যে নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে টাকা তুলছেন, তা ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের আগেই দল জানত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

West Bengal SSC Scam SSC

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}