আর জি কর শুনানিতে (বাঁ দিক থেকে) বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা, প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি মনোজ মিশ্র। ছবি: পিটিআই।
আইন-শৃঙ্খলা রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারের বিষয়। সেই হিসেবে হাসপাতালের নিরাপত্তার ভারও রাজ্য পুলিশের। তা সত্ত্বেও ১৪ অগস্ট মধ্যরাতে আর জি কর হাসপাতালে ভাঙচুরের ঘটনাকে সামনে রেখে আজ সুপ্রিম কোর্ট কলকাতার এই হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের হস্টেলের নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআইএসএফ মোতায়েনের নির্দেশ দিল। রাজ্যের পুলিশের হাত থেকে রাজ্যের রাজধানীর একটি হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় বাহিনীর হাতে চলে গেল।
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির মন্তব্য, ‘‘রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের থেকে প্রত্যাশা ছিল তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করবে। আর জি কর হাসপাতালের মধ্যে অবস্থিত তরুণী চিকিৎসকের খুনের অপরাধের ঘটনাস্থল রক্ষা করবে। আমরা বুঝতে পারছি না, কেন রাজ্য তা করতে পারল না?’’ আজ সুপ্রিম কোর্টে ডাক্তারদের তরফে অভিযোগ জমা পড়েছে, হাসপাতালে হামলাকারীরা মহিলা আবাসিক চিকিৎসকদের হুমকি দেওয়ার পরে তাঁরা হস্টেল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তার পরেই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্ট সিআইএসএফ মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। সিআইএসএফ সাধারণত কেন্দ্রীয় সরকারি দফতর, বন্দর, বিমানবন্দর পাহারা দেয়।
শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশকে তৃণমূল কংগ্রেস শিবির ভবিষ্যতের জন্য বড় রকমের বিপদের দরজা খুলে যাওয়া হিসেবে দেখছে। তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের মতে, এ হল রাজ্যে সংবিধানের ৩৫৫ অনুচ্ছেদের ঘুরপথে প্রয়োগ। যেখানে বলা রয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব হল বাইরের আগ্রাসন বা ভিতরের বিশৃঙ্খলা থেকে রাজ্যকে রক্ষা করা এবং রাজ্য সরকার যাতে সংবিধান অনুযায়ী কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করা। তৃণমূল শিবিরের আশঙ্কা, কেন্দ্র সরাসরি ৩৫৫ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ না করলেও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কার্যত সেটাই হল। রাজ্য পুলিশ আর জি করের নিরাপত্তা দিতে পারছে না, এই তত্ত্বে সুপ্রিম কোর্টের সিলমোহর পড়ে গেল। ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বা রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস একে হাতিয়ার করতে পারেন।
আর জি করে ভাঙচুরের ঘটনার পরে রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী প্রথম কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবকে চিঠি লিখে কলকাতার এই হাসপাতালের নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের আর্জি জানিয়েছিলেন। আজ সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকারের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাই প্রথম আর জি কর হাসপাতালে সিআইএসএফ নিয়োগের প্রস্তাব দেন। প্রথমে তিনি রাজ্যের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
এর পরে রাজ্যের চিকিৎসকদের একটি সংগঠনের হয়ে আইনজীবী অপরাজিতা সিংহ অভিযোগ তোলেন, আর জি কর হাসপাতালের মহিলা আবাসিক চিকিৎসকরা হস্টেলে নিরাপদ বোধ করছেন না। তাঁদের পরিবার বাড়িতে ফিরে যেতে বলছে। আর জি করের ৭০০ জন আবাসিক ডাক্তারদের মধ্যে ২৫০ জন মহিলা। এই ৭০০ জনের মধ্যে মাত্র ১০০ জন হস্টেলে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ৩০-৪০ জন মহিলা চিকিৎসক। ৬০-৭০ জন পুরুষ ডাক্তার। বাকিরা চলে গিয়েছেন। আর জি কর হাসপাতালে ভাঙচুরের সময়ে পুলিশ পালিয়ে গিয়েছিল। অনেক পুলিশ কর্মী নার্সদের পোশাক বদলানোর ঘরে গিয়ে লুকিয়েছিলেন। হামলাকারীরা হস্টেলে হানা দেয়। সেখানে প্রতিবাদ আন্দোলনে নামা মহিলা চিকিৎসকদের নাম করে ডেকে হুমকি দেওয়া হয়, তাঁদেরও ওই তরুণী চিকিৎসকের মতো ভাগ্য হবে। ডাক্তারদের তরফ থেকে একটি লিখিত অভিযোগও তুলে দেওয়া হয় প্রধান বিচারপতির হাতে। অপরাজিতা জানান, এই অভিযোগ ১৯ অগস্ট কলকাতা পুলিশের কাছেও ই-মেল করে পাঠানো হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি জে বি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি মনোজ মিশ্র দীর্ঘক্ষণ ধরে সেই অভিযোগ খুঁটিয়ে পড়েন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘এটা অত্যন্ত গুরুতর বিষয়। যখন ১৪ অগস্ট রাতে প্রতিবাদ হচ্ছিল, তখন একটা অংশ যে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করতে পারে, সে সম্পর্কে রাজ্য সরকার অচেতন থাকতে পারে না। ডাক্তারদের উপরে হামলার সময়ে পুলিশ পালিয়ে গিয়েছিল। তার পরে মহিলা ডাক্তারদের নাম ধরে হুমকি দেওয়া হয়েছে। যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁদের ওই মৃতা চিকিৎসকের মতো একই ভাগ্য হবে বলে শাসানো হচ্ছে। পুলিশের কাছে এই অভিযোগ গিয়েছে। পুলিশ কী করেছে?” রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, রাজ্য ব্যবস্থা নিয়েছে। ৩৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আমরা অভিযোগকারীদের নাম প্রকাশ করতে চাই না। এটা কোনও সাধারণ অভিযোগ নয়।’’ বিচারপতি পারদিওয়ালা বলেন, ‘‘আমরা ডাক্তারদের কাছে আবেদন করছি যাতে তাঁরা কাজে ফেরেন। যাতে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা পেতে সমস্যা না হয়। এখন চিকিৎসকদের যদি নিরাপত্তা দিতে বলি, তা হলে কি এই চিকিৎসকরা নিরাপত্তা পাবেন? কোন পুলিশ হাসপাতালের নিরাপত্তা দেবে?”
এই সময়ই কেন্দ্রীয় সরকারের সলিসিটর জেনারেল বলেন, ‘‘এ হল হিমশৈলের চূড়া। আমরাও অভিযোগ পেয়েছি। এটাই কঠোর বাস্তব পরিস্থিতি।’’ রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমারের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে সারদা মামলায় প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। সিব্বল বলেন, এর সঙ্গে আর জি করের ঘটনার সম্পর্ক নেই। মেহতা বলেন, পুলিশের অজ্ঞাতে হাসপাতালে এত লোক ঢুকতে পারে না। আর জি করে সিআইএসএফ মোতায়েনের প্রস্তাব দেন। এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের হয়ে কপিল সিব্বল বলেন, সুপ্রিম কোর্ট যদি ঠিক মনে করে, তা হলে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই। সেক্ষেত্রে সিআইএসএফ-ই পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে। কারণ একই জায়গায় দু’রকম বাহিনী থাকতে পারে না। প্রধান বিচারপতি অবিলম্বে যথেষ্ট সংখ্যক সিআইএসএফ মোতায়েনের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ওই হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়ে আস্থা ফিরলে বাকি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও কাজে ফেরার ভরসা পাবেন। রাজ্যের আইনজীবীরও এতে আপত্তি নেই। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘আমাদের আশা এবং বিশ্বাস আর জি করে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থার ফলে ডাক্তারেরা দ্রুত কাজে ফিরবেন। আরও কোনও উদ্বেগের বিষয় থাকলে সেটা তাঁরা সুপ্রিম কোর্টকে জানাতে পারেন।’’
তৃণমূল নেতাদের মতে, সুপ্রিম কোর্ট যে ভাবে রাজ্যকে তোপ দেগেছে, সেই পরিস্থিতিতে কপিল সিব্বল সিআইএসএফ নিয়োগ নিয়ে আপত্তি তুললে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যেত। সুপ্রিম কোর্টে রাজ্যের আইনজীবী সঞ্জয় বসু বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট আজ যা রায় দিয়েছে, তার সঙ্গে রাজ্য সরকার একমত। পশ্চিমবঙ্গে যাতে ৯ অগস্টের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, তার জন্য রাজ্য সরকার সব রকম পদক্ষেপ করবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy